রাজনৈতিক অস্থিরতায় স্বর্ণ চোরাচালানে নতুন রূপ উদ্ভাবন করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর ফলে দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বর্ণ আটকের ঘটনা বেড়েছে।
আকাশপথে এ ধরনের চোরাচালানে মূল হোতার সহযোগী হিসেবে সিভিল অ্যাভিয়েশন ও শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মী, পুলিশ, আনসার ও বিমানবন্দরগুলোতে কর্মরত বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম মাঝেমধ্যেই প্রকাশ পায়। এর পাশাপাশি পাইলট, কো-পাইলট, এয়ারক্র্যাফট মেকানিক, সহকারী এয়ারক্র্যাফট মেকানিক, জুনিয়র টেকনিশিয়ান, শিডিউল বিভাগ, ক্লিনিং বিভাগ, ক্যাটারিং বিভাগ, অপারেশন ও ট্রেনিং বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম আছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।
শুক্রবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে সিলেটে ওসমানী বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে ৩৪ কেজি স্বর্ণ উদ্ধারের পর বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। বিমানবন্দর ও সিভিল অ্যাভিয়েশনের সিন্ডিকেট ছাড়া এভাবে স্বর্ণ পাচার করা সম্ভব নয়। এর আগে বৃহস্পতিবার ভোরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট থেকে ৪৯টি স্বর্ণ বার উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ।
বিমানবন্দরের সূত্রগুলো বলছে, সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতায় স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটগুলো তাদের কার্যক্রম অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের তিনটি বিমানবন্দর ঘিরে সমানতালে স্বর্ণ চোরাচালানে ব্যস্ত এই সিন্ডিকেটগুলো। বিমানবন্দর পরিচালনা ও নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই চোরাচালান চলছে।
সিলেট অফিস ও দক্ষিণ সুরমা সংবাদদাতা জানায়, সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-২৪৮ বিমান শুক্রবার সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে অবতরণ করার পর সেখান থেকে তল্লাশি করে ৩৪ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। আটক স্বর্ণের ওজন প্রায় পাঁচ কেজি ৬৮৪ গ্রাম। যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মোহাম্মদ হাবিবুর, সানু মিয়া, আখতারুজ্জামান ও মিসফাহ মিয়া নামে চার জনকে আটক করেছে।
ওসমানী বিমানবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার সাজেদুল করিম জানান, উদ্ধারকৃত স্বর্ণের মধ্যে ২৮০ পিস স্বর্ণের বার রয়েছে। এছাড়া ছয়টি পেস্ট করা স্বর্ণের ডিম উদ্ধার করা হয়েছে। বিমানের দুটি সিটের নিচ ও ওয়াশরুম থেকে স্বর্ণের বারগুলো উদ্ধার করা হয়। বার ও বল আকারে থাকা এসব স্বর্ণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখা ছিল। বিমানে তল্লাশি করে কয়েকটি আসনের নিচ থেকে স্কচটেপ প্যাঁচানো অবস্থায় স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। পরে বিমানের শৌচাগার তল্লাশি করে লুকিয়ে রাখা স্বর্ণের ‘ডিম’ উদ্ধার করা হয়। সব মিলিয়ে ২৮০ স্বর্ণের বার ও ছয়টি ডিম আকারের স্বর্ণের বল জব্দ করা হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে বিমান থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থার লোকজন জড়িত। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততাও পাওয়া গেছে। বছর দুয়েক আগে একজন উপজেলা চেয়ারম্যানকেও এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিভিন্ন সময়ে বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রেফতার হয়েছে।
ঐ কর্মকর্তা আরো বলেন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কাতার, ওমান, কুয়েত এবং পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া ও সিংগাপুর থেকে স্বর্ণ কেনার পর মূল হোতা ‘ক্যারিয়ার’ বা বাহক হিসেবে প্রবাসী শ্রমিক, লাগেজ ব্যবসায়ী বা পর্যটককে বেছে নেন। এরপর বাংলাদেশ বিমান বা দেশের অন্য বেসরকারি এয়ারলাইনসের বিমানের যাত্রী হয়ে স্বর্ণ বহন করবেন—এই শর্তে যাতায়াতের টিকিট ও কিছু নগদ টাকা দেওয়া হয়।
স্বর্ণ পাচারের একটি নতুন রূপ উদ্ঘাটন করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই পদ্ধতিতে, স্বর্ণ বহনকারী যাত্রীরা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর স্বর্ণ বিমানেই রেখে বের হয়ে যান। পরে বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সিভিল অ্যাভিয়েশন ও শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের সহায়তায় স্বর্ণ বিমান থেকে বের করে হ্যাংগার গেট বা কার্গো ভিলেজে নেওয়া হয়। সেখানে অপেক্ষমাণ গাড়ির মাধ্যমে স্বর্ণ চোরাচালানকারীদের কাছে পৌঁছে যায়।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post