দেশের সোনার বাজারে রীতিমতো অস্থিরতা বিরাজ করছে। গত নভেম্বর মাসেই চার দফা দাম বেড়েছে মূল্যবান এই ধাতুটির। এতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের মধ্যেও চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। দাম বাড়ার পেছনে প্রধানত ৪টি কারণ চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবিদ, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা।
তাদের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও অকার্যকর আমদানি নীতির কারণে মূলত মূল্যবান ধাতুটির বাজারে অস্থিরতা চলছে।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে সর্বশেষ গত ২৯ নভেম্বর প্রতি ভরিতে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭৫০ টাকা বেড়ে ভালো মানের অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৮৭৫ টাকা। দেশের বাজারে এটিই সোনার সর্বোচ্চ দাম। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে প্রতি ভরি সোনার দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ তিন বছরে সোনার মূল্যের বৃদ্ধি হয়েছে ৫৭ শতাংশেরও বেশি।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে দাম ছিল ৭০ হাজার টাকার কম। চলতি বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারিতে দেশে প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল ৯৩ হাজার ৪২৯ টাকা। জুলাইতে এসে এই দাম এক লাখ অতিক্রম করে এবং গতকাল রোববার হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার টাকা। চলতি বছরের ১১ মাসে সোনার দাম ভরিতে ১৬ হাজার ৪৪৬ টাকা বা ১৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এম এ হান্নান বলেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার কারণে বাংলাদেশেও বাড়ছে। এটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে সোনার দাম বাড়ার পেছনে আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ সুদহারের শিল্প কর্মকাণ্ড ব্যাপক কমেছে এবং কর্মসংস্থানেও ধীরগতি হয়েছে। এ কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ায় বিশ্ববাজারে সোনায় বিনিয়োগ বাড়ছে, এতে দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণেও দেশে দাম বেড়েছে।
সোনার আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূলত করোনা মহামারির পর বিশ্বব্যাপী সোনার দামে অস্থিরতা দেখা দেয়। তখন বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম দুই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। করোনার পর সোনার দাম কিছুটা কমলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আবার বাড়ে। গত বছরের শেষ দিকে সোনার দাম কিছুটা কমে। চলতি বছর আবার দামি এই ধাতুর দাম বাড়তে থাকে।
গত মে মাসে আবার আউন্সপ্রতি সোনার দাম ২ হাজার ৫০ ডলারে পৌঁছায়। তারপর দাম নিম্নমুখী থাকলেও ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর আবার বাড়তে থাকে। সর্বশেষ গত শুক্রবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স সোনা ২ হাজার ৭২ ডলারে বিক্রি হয়েছে। গত দুই মাসে মূল্যবান ধাতুটির দাম বেড়েছে ২৪৪ ডলার বা ১৩.৩৪ শতাংশ। গত ২ অক্টোবর প্রতি আউন্স সোনার দাম ছিল ১ হাজার ৮২৮ ডলার।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যখন অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বেড়ে যায়, তখন স্বর্ণের দাম বেড়ে যায়। আবার মুদ্রাস্ফীতি হলেও সোনার দাম বাড়ে। বিশ্বব্যাপী অনেক দেশে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি চলছে। তাই সোনার দাম বাড়াটা স্বাভাবিক। সোনা হচ্ছে একটি নিরাপদ ধাতু, এটা নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। এ কারণে বিশ্বের বড় বড় ব্যাংকগুলো সোনা কেনা শুরু করেছে।
আর্থিক নিরাপত্তার কারণে তারা সোনার মজুত বাড়াচ্ছে। এ জন্য সোনার একটা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে হু হু করে দাম বেড়ে গেছে। আর জ্বালানি তেলের কেনাবেচার সঙ্গেও সোনার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সোনার দামও বেড়ে যায়। কারণ তখন অনেক দেশই সোনার বিনিময়ে জ্বালানি তেল বিক্রি করে। আর যেহেতু এখন ডলারের কারণে বিশ্বের মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা চলছে, ফলে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে সোনার চাহিদাও বাড়ছে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগারওয়াল বলেন, ‘বাংলাদেশে সোনা তৈরি হয় না। সোনা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর সঙ্গে ডলারের সম্পর্ক রয়েছে। তাই সোনার দাম বাড়ার একটি কারণ হলো ডলারের দাম বৃদ্ধি।’
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশে সোনার দামের ক্ষেত্রে উল্লম্ফন ঘটেছে কিন্তু এই উল্লম্ফনের কোনো যৌক্তিক ও সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। যুদ্ধ ও অন্যান্য কারণে দাম বাড়বে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এতটা বাড়বে কেন? এভাবে আকাশচুম্বী হচ্ছে দাম সোনার কার্যকর বাজারব্যবস্থা ও রেগুলেশন্স না থাকায়।
বাজুসের কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়া সোনার বিশ্বের অন্যতম প্রধান উৎপাদক। কিন্তু যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার স্বর্ণ বাজারে আসতে পারছে না। যুদ্ধ শেষ হলে হয়তো দাম কমতে পারে। কিন্তু ডলারের বিনিময় হার ও ক্রুড অয়েলের দাম বেড়ে যাওয়ায় দাম কমার আপাতত কোনো লক্ষণ নেই।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post