ফারজানা আক্তারের ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার এক কোটি ২৮ লাখেরও বেশি। তাঁর চ্যানেলের মোট ভিউ ছাড়িয়ে গেছে ৩৪৩ কোটি। দেশ তো বটেই, ছবি আঁঁকা শেখানোর শীর্ষস্থানীয় ইউটিউব চ্যানেলের মধ্যে তাঁর ‘ফারজানা ড্রয়িং একাডেমি’ অন্যতম। এই চ্যানেল থেকে উপার্জিত অর্থে কিনেছেন তিনটি ফ্ল্যাটও।
চলুন শুনে আসি তাঁর সফলতার গল্প , ফারজানা বাবা মো. জাহাঙ্গীর আলম ছবি আঁঁকতেন। ছোট্ট ফারজানা তা দেখতেন। সেখান থেকেই তাঁর শিশু মনে আঁঁকাআঁঁকির প্রতি আগ্রহ জন্মায়। টুকটাক একা একাই আঁঁকার চেষ্টাও করতেন।
কখনো কখনো পেন্সিলে আঁঁকা তাঁর স্কেচ মুগ্ধ করত সবাইকে। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফারজানার আঁঁকাআঁঁকি শেখা আর হয়ে ওঠেনি। ইউটিউব থেকেই ফারজানা আর্টের নানা বিষয় শেখেন।
১৪ ভিউতেই খুশিতে আটখান
২০১৭ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম ভিডিওটি নিজের ইউটিউব চ্যানেলে (Farjana Drawing Academy) দেন। যেদিন দেন তার পরের দিন দেখেন মাত্র ১৪টি ভিউ হয়েছে। ফারজানা তাতেই খুশি। চ্যানেল খোলার কয়েক মাস আগেও ইউটিউবে চ্যানেল খোলার বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। স্বামী মোস্তাফিজুর রহমানই ফারজানাকে ইউটিউবে চ্যানেল খুলতে বলেন।
প্রথম আয়
অ্যাডসেন্স পিন ভেরিফিকেশনে সময় লাগায় ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রথম আয়ের টাকা তিনি মাস পাঁচেক পরে তুলতে পারেন। সেটা ছিল ৬৫ হাজার টাকা। একই সময় তিনি আরো ৪০ হাজার টাকা আয় করেন। এরপর আর ফারজানাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
ফারজানা জানান, ইউটিউব চ্যানেলে বেশি ভিউ থাকলে বিজ্ঞাপন আসে। ওই বিজ্ঞাপনের অর্থের একটি অংশ পান চ্যানেলের মালিক। ৯টা-৫টা অফিস। যখন তখন বসের খবরদারি। এটা ফারজানার পছন্দ নয়। ফারজানা বলেন, ‘নিজের মতো কাজ করতে পারি। এটা অনেক শান্তির।’
বাংলাদেশের প্রথম ডায়মন্ড বাটন
ফারজানার ইউটিউব চ্যানেলের বর্তমান সাবস্ক্রাইবার এক কোটি ২৮ লাখেরও বেশি। চ্যানেল খোলার পর এক লাখ সাবস্ক্রাইবার হওয়ায় প্রথম তিনি পেয়েছেন ‘সিলভার প্লে বাটন’। ১০ লাখ গ্রাহক হওয়ার পর পেয়েছেন ‘গোল্ড বাটন’। আর এক কোটি গ্রাহক হওয়ার পর তাঁর ঝুলিতে যোগ হয়েছে ‘ডায়মন্ড বাটন’। ইউটিউবার হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে তিনিই বাংলাদেশের প্রথম ‘ডায়মন্ড বাটন’ পেয়েছেন।
মার্কিন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যানালিটিকস ওয়েবসাইট ‘সোশ্যাল ব্লেড’-এর হিসাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সাবস্ক্রাইবার থাকা ইউটিউব চ্যানেলগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে আছে ‘ফারজানা ড্রয়িং একাডেমি’৷ এই লেখার সময় তাঁর চ্যানেলটির ভিডিওগুলোর মোট ভিউ ৩৪৩ কোটি আট লাখ ২০ হাজার। তাঁর চ্যানেলের সবচেয়ে বেশি দর্শক ভারতের। তাঁর মোট ভিউয়ের ৪৪ শতাংশ সেখানকার মানুষ। বাংলাদেশ থেকে ৬ এবং ইউএসএ থেকে দেখছেন ৫.০৯ শতাংশ মানুষ। প্রায় এক হাজার ৪০০ ভিডিও তাঁর চ্যানেলে রয়েছে।
ফারজানা যা শেখান
ফারজানার চ্যানেলে মূলত পেন্সিল স্কেচ শেখানো হয়। তবে সেটা খুব সহজভাবে, সহজ উপায়ে, সহজলভ্য উপকরণ ব্যবহার করে। ফারজানার ভিডিওগুলোতে আবহ সংগীত থাকলেও কোনো কণ্ঠ নেই। নেই কোনো বর্ণনা। ডার্ক পেন্সিল আর সহজ কৌশল—এই দুটো বিষয়ই নিজের আঁঁকাআঁঁকির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন ফারজানা। দর্শকদের আগ্রহের বিষয়গুলো শেখানোর চেষ্টা করেন তিনি। মানুষের প্রতিকৃতি, প্রাকৃতিক দৃশ্য, বিভিন্ন প্রাণীর মুখ—এসব কিছু ফারজানার আঁঁকাআঁঁকিতে ধরা দেয় বেশি।
মুঠোফোনেই সব
ফারজানার নেই কোনো স্টুডিও। ছবি আঁঁকেন, ভিডিও, সম্পাদনা সবই করেন এক হাতে। বারান্দায় একটি টেবিলে মুঠোফোন সেট করে তাতেই করেন ভিডিও। ঘণ্টাখানেকের মতো সময়ে তৈরি হয় একটি স্কেচ। এরপর সম্পাদনা করে আপলোড করেন। চার-পাঁচ দিন পর পর তিনি ভিডিও দেন।
ডোরেমন কর্তৃপক্ষেরও ধন্যবাদ জ্ঞাপন
ইউটিউব চ্যানেলের শুরুর দিকে ফারজানার মূল লক্ষ্য ছিল বাচ্চাদের নিয়ে। ঠিক সে কারণেই চ্যানেলের মূল লোগো তৈরি করেন জনপ্রিয় ডোরেমন চরিত্রটি দিয়ে। ডোরেমন কর্তৃপক্ষের নজরে বিষয়টা এলে তারা ফারজানার ৩০০টি ভিডিওতেই কপিরাইট স্ট্রাইক দেয়। অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল তাঁর এই ভিডিওগুলো। হাতে ছিল মাত্র ছয় দিন সময়।
এই সময়ের মধ্যে কিছু করতে না পারলে চ্যানেল হয়ে যাবে ডিস-অ্যাবল। ফারজানার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কী করবেন ভাবতে ভাবতে চলে যায় তিন দিন। পরে অবশ্য ডোরেমন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। যোগাযোগ করায় ডোরেমন কর্তৃপক্ষ যেন খুশিই হয়। ভুল স্বীকার করে ডোরেমন চরিত্রটি রিমুভ করে দিলে উল্টো তারা ফারজানাকে ধন্যবাদও জানায়।
আড়ালের মানুষ
বাংলাদেশের একজন সেরা ইউটিউবার—সেটা ভিউ, সাবস্ক্রাইবার উভয় দিক দিয়েই। তবুও ফারজানাকে নিয়ে তেমন প্রচারণা নেই। অনেকটাই আড়ালের মানুষ তিনি। নিভৃতে শুধু ভালো লাগার কাজটাই করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। এমনটি হওয়ার নেপথ্যে অবশ্য ফারজানা নিজেই। তিনি বলেন, ‘অনেক টিভি চ্যানেল থেকে আমাকে ইন্টারভিউর জন্য ডেকেছিল, কিন্তু এসব এড়িয়ে চলি। এসব করলে অনেকেই হয়তো আমার সম্পর্কে জানতে পারত, কিন্তু এতে করে আমার কাজের অনেক ক্ষতি হয়ে যেত।’
ফারজানা তাঁর পরিবার নিয়ে থাকেন ঢাকার উত্তরায়। স্নাতকোত্তর করেছেন কুমিল্লার সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে থেকে। স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান ব্যবসা করেন। তাঁদের একমাত্র ছেলে সৌরভ স্কুলে পড়াশোনা করে।
ইউটিউবের আয়ে তিন ফ্ল্যাট
ইউটিউব চ্যানেলের আয়ে কুমিল্লায় দুটি ফ্ল্যাট, ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন ফারজানা। শুধু তাই নয়, দৈনন্দিন খরচের অনেকটাই জোগান হয় এখান থেকে।
নতুনদের জন্য পরামর্শ
ইউটিউব থেকে আয় করে চলতে হবে—এমন ভাবনা তাঁর কখনোই ছিল না। তিনি নিজের আঁঁকাআঁঁকিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। ভুল থেকে শিখেছেন। নতুনদের জন্য তাঁর পরামর্শটা হচ্ছে—শুরুতেই আয় নয়, ভিউয়ের চিন্তা নয়। নিজের কাজটা সুন্দরভাবে করতে হবে। কাজ ভালো হলে ভিউ এমনিতেই বেশি হবে। নতুনরা কাজের মানের দিক না ভেবে শুরুতেই আয় নিয়ে বেশি ভাবে। ফলে মূল লক্ষ্যটা আড়ালে থেকে যায়।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post