রামিশা ও রাফিসা নামে ছোট্ট দুই সন্তানের মা সায়মা জেরিন। বিয়ে হয়েছিল ১৪ বছর আগে। বনিবনা হচ্ছিল না স্বামীর সঙ্গে। অভিমানে বেছে নিলেন আত্মহত্যার পথ। সুন্দর সাজানো-গোছানো সংসারটা তছনছ। মাকে হারিয়ে রামিশা ও রাফিসার দুই চোখে অন্ধকার।
জেরিন শশুর বাড়িতে ‘কেরির বড়ি’ (পোকা মারার ওষুধ) খেয়ে আত্মহত্যা করেন গত ৭ নভেম্বর। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার উত্তর পৈরতলার ছয়ঘড়িয়া পাড়ার আবুল কাসেমের মেয়ে। পৌর এলাকার গোকর্ণঘাট দক্ষিণপাড়ার গণি মিয়ার ছেলে হান্নানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। জেরিন আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হলেও বাবার বাড়ির লোকজনের দাবি- তাকে যৌতুকের জন্য মারা হয়েছে।
হঠাৎ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। গত এক মাসে একজন সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষার্থীসহ ২০ জন আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে জেলার সরাইলে এক যুবক ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেন। দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক অশান্তিসহ বিভিন্ন কারণে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তবে তাদের বেশিরভাগই আত্মহত্যা করেছেন পোকা মারার ওষুধ ‘কেরির বড়ি’ খেয়ে।
হঠাৎ করে এই আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন সুশীল সমাজ। বিষয়টি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত সদর উপজেলার আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায়ও আলোচনা হয়।
গত ৭ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত এই ২০ জন আত্মহত্যা করেন। এর মধ্যে চলতি মাসের ১০ দিনে ১০ জন আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়াদের মধ্যে বেশিরভাগই কিশোর-কিশোরী কিংবা মাঝ বয়সী।
গত ৭ অক্টোবর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার শিমরাইলকান্দির শান্ত মিয়া (১৮)। পরিবারের দায়িত্ব নিতে বলায় বাবা শাহ আলমের সাথে রাগ করে ৫ অক্টোবর কেরির বড়ি খান শান্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে দুই দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ৭ অক্টোবর দুপুরে তিনি মারা যান।
গত ৯ নভেম্বর বৃহস্পতিবার জেলার কসবা উপজেলার বিশারা বাড়ি গ্রাম থেকে গৃহবধূ তামান্না আক্তারের (২৬) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পারিবারিক কলহের জের ধরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করা হচ্ছে।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আফসানা হক সাথীর (৩৩) আত্মহত্যা নিয়ে জেলায় বেশি আলোচনা হয়। গত ১ নভেম্বর পোকা মারার ওষুধ খেয়ে তিনি মারা যান। আফসানা হক সাথী দুই ছেলে সন্তানের মা। তার মৃত্যুর পর ওই দুই শিশু অসহায় হয়ে পড়ে। কেননা, স্বামী ইমরান খানের সঙ্গে পারিবারিক কলহের জের ধরে তিনি আত্মহত্যা করায় শিশুদের বাবার সঙ্গে রাখতে চাইছেন না পরিবারের লোকজন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নাটাই দক্ষিণ ইউনিয়নে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন আফসানা হক। আশুগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের ফজলুল হকের মেয়ে আফসানার সঙ্গে ২০১১ সালে জেলার বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামের আলী হায়দারের ছেলে ইমরান খান সবুজের বিয়ে হয়। যৌতুকের চাপ, স্বামীর পরকীয়া ও মারধর সইতে না পেরে আফসানা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে পরিবারের লোকজন অভিযোগ করেন।
এদিকে গত ৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার ছয়বাড়িয়ার শ্বশুরবাড়িতে এসে দুবাই প্রবাসী মোবারক হোসেন (২৫) নামে এক যুবক ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। পৌর এলাকার পীর বাড়ির আব্দুল আলীমের ছেলে মোবারক হোসেন সাত মাস আগে বিয়ে করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার সোনারামপুর গ্রামের বাসিন্দা ও মাদরাসা শিক্ষার্থী শিপা আক্তার ২ নভেম্বর বাড়ির পাশের একটি ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। মাদরাসায় যেতে না চাইলে মা শাসন করায় শিপা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় বলে পুলিশের একটি সূত্র জানায়।
এ মাসের শুরুতে অর্থাৎ ১ নভেম্বর একই দিনে তিনজন আত্মহত্যা করেন। এর মধ্যে আখাউড়ায় নুপুর আক্তার নামে কিশোরী, নবীনগরে সিদ্দিক মিয়া নামে এক মানসিক রোগী ও বিজয়নগরে মো. শাওন নামে এক অটোরিকশা চালক আত্মহত্যা করেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে জেলার আখাউড়া উপজেলার নুরপুর গ্রামের সুমন মিয়ার মেয়ে নুপুর আক্তার (১৫) ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। মোবাইল ফোনে আসক্ত হওয়ায় বাবা-মা বাদ সাধলে অভিমানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন নুপুর।
একই দিন জেলার নবীনগরে কেরির বড়ি খেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন সিদ্দিক মিয়া (৪৮) নামে এক মানসিক রোগী। তিনি উপজেলার বিদ্যাকুট ইউনিয়নের বিদ্যাকুট গ্রামের ফিরোজ মিয়ার ছেলে। তিনি মানসিক অস্থিরতার পাশাপাশি হতাশায় ভুগছিলেন বলে পারিবারিক সূত্র জানায়।
বিজয়নগরে স্ত্রীর সঙ্গে অভিমান করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেন চম্পকনগর ইউনিয়নের নুরপুর গ্রামের আলী আহম্মেদের ছেলে শাওন মিয়া। স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িত এমন সন্দেহ থেকে তিনি গলায় বেল্ট পেঁচিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।গত মাসে আত্মহত্যা পথ বেছে নেন বিজয়নগর উপজেলার পত্তনের পাপিয়া সুলতানা পুতুল (২৮),
আখাউড়ার রাজপুর গ্রামের মামুন ভূঁইয়া (৪০), কসবা উপজেলার মারজান আক্তার লিয়া (১৫), নাসিরনগরের কদমতলী গ্রামের শাকিল মিয়া (২০), ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার ইয়াসমিন আক্তার (২০), বিজয়নগরের চান্দুরা গ্রামের মুসাব্বির মিয়া (৩০), আখাউড়ার ভাটামাথা গ্রামের দীঘিরপাড় এলাকার শায়লা আক্তার, নাসিরনগরের ফান্দাউক গ্রামের মোতাব্বির চৌধুরী (১৮)।
এর মধ্যে কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার শাহীন মিয়ার মেয়ে মারজান আক্তার এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষায় পাস করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। আখাউড়া উপজেলার আজমপুর এলাকায় গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) সকাল ১০টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার কুন্ডা ইউনিয়নের কুন্ডা গ্রামের বেড়িবাঁধ এলাকায় ওসমান ফিশারিজের ভিতরে নির্মাণাধীন মসজিদ থেকে মো. জুবাইদ মিয়া (২০) নামের এক যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। জুবাইদ উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়নের কাঠালকান্দি গ্রামের মাস্টারপাড়া এলাকার আহাম্মদ আলীর ছেলে।
জুবাইদের মামা বকুল হোসেন জানান, জুবাইদ একজন মানসিক রোগী। গত (৮ নভেম্বর) বুধবার সকাল থেকে জুবাইদ নিখোঁজ ছিলেন। কোথাও তার খোঁজ মিলছিল না। জুবাইদ বৃহস্পতিবার সকালে সবার অগোচরে গিয়ে কুন্ডা গ্রামের বেড়িবাঁধ এলাকায় ওসমান ফিশারিজের ভেতরে নির্মাণাধীন মসজিদে মাচার সঙ্গে পরনের লঙ্গি পেচিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এছাড়া শুক্রবার (১০ নভেম্বর) ভোর ৫টার দিকে বিজয়নগর উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়নের তুলাতলা গ্রামে গলায় ফাঁস দিয়ে আমেনা খাতুন (৩৫) নামে এক মানসিক রোগী আত্মহত্যা করেছেন। আমেনা খাতুন একই গ্রামের মৃত আবু তাহেরের মেয়ে ও উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের মনিপুর গ্রামের মো. রইছ মিয়ার স্ত্রী।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ২৫ বছর আগে আমেনা খাতুনকে উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের মনিপুর গ্রামের মৃত তকদির হোসেনের ছেলে মো. রইছ মিয়ার সাথে বিয়ে দেন। তিন ছেলে নিয়ে তাদের সুন্দর সংসার। ছয় বছর আগে আমেনা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে পরীক্ষায়-নিরীক্ষায় আমেনা খাতুনের মানসিক রোগ ধরা পড়ে। অনেকবার চিকিৎসা হয়েছে আমেনার, কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি।
গত বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) দুপুরে আমেনা তার চাচির কুলখানি খেতে ইছাপুর তুলাতলা বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে সবার অগোচরে গিয়ে আমেনা ধান রাখার ঘরের তীরের সাথে ওড়না পেচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত সদর উপজেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় সম্প্রতি আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভায় বক্তারা কিশোর-কিশোরীদের প্রতি বিশেষ নজর রাখার জন্য অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান এবং কৃষি অফিসারের লিখিত অনুমতি ছাড়া কেরির বড়ি যাতে বিক্রি না করা হয়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ এ এস এম শফিকুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আত্মহত্যার ক্ষেত্রে পরিবার ছোট হয়ে যাওয়া, মাদকাসক্তি, মোবাইল ফোনে আসক্তিসহ নানা কারণ আছে। এক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষাটা বড়। পরিবারের ছোট সদস্যদের মাঝে সফলতা উদযাপনের পাশাপাশি ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলায় মনোনিবেশ করাতে হবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান ও জেলা নাগরিক কমিটির সভাপতি ডা. মো. আবু সাঈদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের যে সময়টা তখন তাদের পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ রেখে সাপোর্ট দিতে হবে। তাদের মধ্যে কোনো হতাশা দেখা দিলে সেটা দূর করতে কাজ করতে হবে।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post