তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, জালিয়াতির মাধ্যমে পাসপোর্ট ইস্যু করার জন্য পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা বিভিন্ন প্রকার প্রতারণা করেছেন। তারা আবেদনকারীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছেন, অথবা জাল কাগজপত্রের ভিত্তিতে পাসপোর্ট ইস্যু করেছেন। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আবেদনকারীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও নেওয়া হয়নি।
জালিয়াতির ঘটনাটি প্রকাশ হওয়ার পর পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক ও সহকারী পরিচালককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তবে তারা তদন্তকাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার চেষ্টা করেন। তারা তদন্ত কমিটির সদস্যদের হুমকি দেন এবং তাদের কাছ থেকে চাপ প্রয়োগ করেন।
উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি দুই কর্মকর্তার বিস্তর অনিয়মের প্রমাণসহ প্রতিবেদন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে জমা দেয়। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. নূরুল আনোয়ার গত সেপ্টেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব আব্দুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা একটি তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি। সেই প্রতিবেদনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। বিধিমোতাবেক পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ইস্যু করা পাসপোর্টের ৫৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ নথিপত্র কমিটিকে সরবরাহ করা হয়। তাতে ৩ হাজার ৪০৭টি অনিয়মের সরাসরি প্রমাণ পায় কমিটি। তবে অনুসন্ধানকালে কমিটি ১০ হাজার ৩৮টি এমআরপি নিয়মবহির্ভূতভাবে ইস্যু করার প্রমাণ পায়। বিপুলসংখ্যক এমআরপি দেওয়াকেও অস্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করে কমিটি। তাই চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মো. আবু সাইদ ও সহকারী পরিচালক এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করতে বলেছেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
জানা গেছে, মো. আবু সাইদ এখন খুলনা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি গতকাল রোববার রাতে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘একজন নাগরিক চাইলে তাকে পাসপোর্ট দিতে হবে। সেখানে এমআরপি চাইলে তাকে না করার কোনো সুযোগ নেই। এমআরপি ইস্যু করার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম করিনি। আর তদন্ত কমিটি কী কী অনিয়ম পেয়েছে তা আমি জানি না। তাই এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্যও নেই।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এমআরপি সরবরাহে অনিয়মের ঘটনায় ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (বর্তমানে ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার) উম্মে সালমা তানজিয়াকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছিল। কমিটি দীর্ঘ সময় তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার ২০২০ সাল থেকে ই-পাসপোর্ট চালু করে এমআরপি নিরুৎসাহিত করতে নির্দেশনা দিলেও চট্টগ্রামের মনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসে ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে ৩ হাজার ৪০৭টি এমআরপি ইস্যু করা হয়। এসব পাসপোর্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে চরম অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এসব অনিয়মের সঙ্গে অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আবু সাঈদ ও সহকারী পরিচালক এনায়েত উল্লাহ সরাসরি জড়িত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পরিচালক মো. আবু সাইদ অফিসপ্রধান হিসেবে ইচ্ছাকৃতভাবে অধিক্ষেত্র-বহির্ভূত এমআরপি আবেদনপত্র, ভুয়া ভিসার কপি ও বিদ্যুৎ বিল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিনা দলিলপত্রে এমআরপি রি-ইস্যু আবেদন জমা নিয়েছেন। তদন্ত চলা আগত সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে বাধাও দিয়েছেন। পরিচালক মো. আবু সাইদের যে অনিয়ম প্রমাণিত হয়েছে অসদাচরণ ও দুর্নীতিপরায়ণতার শামিল। তাই তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করা হয়। আর সহকারী পরিচালক মো. এনায়েত উল্লাহ এমআরপি রি-ইস্যু আবেদন জমা নেওয়ার ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুসরণ না করে প্রয়োজনীয় দলিলপত্র ছাড়া এবং কিছু ক্ষেত্রে ভুয়া দলিলপত্রযুক্ত আবেদনপত্র জমা নিয়ে নিষ্পত্তি করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধেও বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করে কমিটি।
সহকারী পরিচালক মো. এনায়েত উল্লাহ এখন কুড়িগ্রাম জেলা পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত। অভিযোগের বিষয়ে জানতে তাঁকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
জানা গেছে, তদন্ত কমিটির সদস্যরা তদন্তকাজের জন্য চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে গেলে সাক্ষীদের সেখানে যেতে নানাভাবে বাধা দেন অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা। সাক্ষী আবু সৈয়দ মুন্নাকে সাক্ষ্য দিতে যেতে বাধা দেওয়ার খবর পেয়ে কমিটি স্থানীয় গোয়েন্দা পুলিশের সহায়তা নেয়। গোয়েন্দা পুলিশ আবু সৈয়দ মুন্নাকে উদ্ধার করে রাত সাড়ে ১২টায় তদন্ত কমিটির সামনে হাজির করে।
জানা যায়, ওই দুই কর্মকর্তা বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিয়মে বছরজুড়ে এসব পাসপোর্ট ইস্যু করেন। ওই সব এমআরপি ইস্যু করার উদ্দেশ্য ছিল একই ব্যক্তিকে একাধিক পাসপোর্ট ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। তাঁরা জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৪৬টি, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৭৫টি, মার্চে ৯২৭টি, এপ্রিলে ৮৭৬টি, মে মাসে ৮৯৮টি, জুনে ৫৯২টি এবং জুলাইয়ে ৭৯৮টি এমআরপি ইস্যু করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে ২০২২ সালের ২১ জুলাই পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে এমআরপি বন্ধ করতে চিঠিও দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা তাতেও থামেননি। বরং তারা আগস্ট মাসে ১ হাজার ৫১৩টি, সেপ্টেম্বরে ৬৬০টি, অক্টোবরে ৫১৫টি, নভেম্বরে ৫৬৪টি এবং ডিসেম্বরে ৫৭৮টি এমআরপি ইস্যু করেন।
তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা যায়, পাসপোর্ট ইস্যুসংক্রান্ত নথিপত্র তলব করা হলেও অধিকতর অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসার আশঙ্কায় পরিকল্পিতভাবে সব নথি সরবরাহ করা হয়নি। এক ব্যক্তির নামে ইস্যু করা পাসপোর্ট অন্য ব্যক্তির নামে রি-ইস্যু করারও প্রমাণ পায় কমিটি। এ ছাড়া বিদ্যমান পাসপোর্টে বহির্গমন ও আগমনী স্ট্যাম্পিং না থাকাসহ নানা ধরনের অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত, তারা জেনেশুনে কাজটি করেছে। তাই অপরাধ গুরুতর। আশা করব, মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সেভাবেই ব্যবস্থা নেবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post