মধ্যপ্রাচ্যে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে অকুণ্ঠ সমর্থনের পাশাপাশি অব্যাহত সামরিক সহযোগিতা দিচ্ছে আমেরিকা। কূটনৈতিক–সামরিক সহায়তা বন্ধ হবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতে জড়ানোর অতীত অভিজ্ঞতা থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবারের সংঘাতে ঠিক কতটা জড়াবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
ফিলিস্তিনের গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পরপরই এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান স্পষ্ট করেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়াই ছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশে আছে। কেউ যদি এই পরিস্থিতির ফায়দা নিতে চায় তাহলে বলব, ভুলেও তা করবেন না।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে এই হুমকি ইরান ও দেশটির মিত্রদের দিয়েছেন তা বুঝতে বড় বোদ্ধা হতে হয় না।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন জানিয়েছে, বিগত কয়েক দিনে ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন সেনাদের নিশানা করে একাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী যুদ্ধজাহাজ লোহিত সাগরে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ইয়েমেন থেকে ছোড়া হয়েছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্রের নিশানা ইসরায়েল ছিল বলে ধারণা মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের।
হামাসের হামলার পরপরই ভূমধ্যসাগরে ইসরায়েল উপকূলের কাছাকাছি একটি যুদ্ধবিমানবাহী রণতরি পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। আরও একটি বিমানবাহী রণতরি পাঠাচ্ছে। শিগগিরই সেটি ওই অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছাবে। প্রতিটি রণতরটিতে ৭০টির বেশি করে যুদ্ধবিমান রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণ সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ। এ ছাড়া ‘যদি প্রয়োজন পড়ে’ এই বিবেচনায় অঞ্চলটিতে পাঠানোর জন্য কয়েক হাজার মার্কিন সেনা প্রস্তুত রাখতে নির্দেশও দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা সহযোগী হলো যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবছর অস্ত্র ও গোলাবারুদ মিলিয়ে ইসরায়েলকে ৩৮০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা দিয়ে থাকে ওয়াশিংটন।
যেসব যুদ্ধবিমান দিয়ে ইসরায়েল গাজায় নির্বিচার বোমা হামলা চালাচ্ছে, সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। এ ছাড়া নিশানা করা নির্দিষ্ট বস্তুতে আঘাত হানার ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে কার্যকর যেসব গোলাবারুদ ইসরায়েল ব্যবহার করছে, সেগুলোও যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া। এ ছাড়া ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘আয়রন ডোমে’ ব্যবহার করা কিছু ক্ষেপণাস্ত্রও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ইসরায়েল চাওয়ার আগেই এসব অস্ত্র তেল আবিবকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার গত শুক্রবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মার্কিন কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, ১০ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা সহায়তা প্যাকেজের আওতায় তাঁর প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র ইসরায়েলকে ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের অস্ত্র দিতে চায়। কংগ্রেস যেন তাতে অনুমোদন দেয়।
বাইডেন কংগ্রেসকে এমন আহ্বান জানানোর পরদিনই পেন্টাগনের পক্ষ থেকে একটি ঘোষণা আসে। তাতে বলা হয়, শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা টার্মিনাল হাই অ্যালটিটিউড এরিয়া ডিফেন্স (থাড) একটি এবং একটি প্যাট্রিয়ট দ্রুত মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন কি আরও একটি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সত্যি জড়াতে চান, বিশেষ করে নির্বাচনের বছরে? সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সংশ্লিষ্টতার ইতিহাস বলছে, এ জন্য দেশটিকে বড় মূল্য দিতে হয়েছে। অর্থ, রাজনীতি ও মার্কিনদের প্রাণ—সব বিচারে।
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাইকেল ওরেন মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে দুটি যুদ্ধবিমানবাহী রণতরি পাঠানোর মধ্য দিয়ে এই সংঘাতে জড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তিনি বলেন, ‘আপনার ব্যবহার করার ইচ্ছা না থাকলে তাহলে এসব অস্ত্র বের করবেন না।’
তবে সেথ জি জোনসের মত অবশ্য ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক জোনস বলছেন, গাজা যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে একেবারে অনাগ্রহী বলে ধারণা তাঁর।
মধ্যপ্রাচ্যে দুটি যুদ্ধবিমানবাহী রণতরি পাঠানো নিয়ে সেথ জোনস বলেন, একটি গুলিও না করেই এসব কাজে লাগতে পারে। এর বড় কারণ, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে এসব রণতরির সক্ষমতা। একেবারে শেষ উপায় হিসেবে সরাসরি সংঘাতে এর ব্যবহার হতে পারে।
প্রথম হুমকিটা ইসরায়েলের উত্তরের লেবানন সীমান্তে। বিশেষ করে বললে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। মূলত ইরান–সমর্থিত হিজবুল্লাহকে নিয়েই ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি চিন্তিত।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হামাসের চেয়ে হিজবুল্লাহ বড় হুমকি হওয়ার কারণ তাদের অস্ত্রের ভান্ডার। হিজবুল্লাহর রয়েছে প্রায় দেড় লাখ রকেট–ক্ষেপণাস্ত্র। হামাস যেসব রকেট ব্যবহার করে তার চেয়ে এসব রকেট বেশি শক্তিশালী ও নিশানায় আঘাত করতেও বেশি সক্ষম। গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর ইতিমধ্যে চিরশত্রু ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহর পাল্টাপাল্টির হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
মাইকেল ওরেন বলছেন, ইসরায়েলি সেনারা যখন গাজার অনেক ভেতরে ঢুকে পড়বে এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে লড়াই করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠবে, ঠিক তখনই হিজবুল্লাহ সংঘাতে জড়াবে।
ওরেন বলেন, যদি এটা ঘটে তাহলে লেবাননে হিজবুল্লাহর অবস্থান নিশানা করে যুক্তরাষ্ট্র তার বিমানবাহিনীর সক্ষমতা ব্যবহার করে হামলা চালাতে পারে। ওরেনের ধারণা, এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে না, যা হলে যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযান চালানোর জন্য স্থলসেনা পাঠাতে হতে পারে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ইতিমধ্যে জানিয়েছেন, সংঘাতের বড় ধরনের বিস্তার ঘটলে, মার্কিন সেনা ও সামরিক অবস্থান লক্ষ্য করে কোনো ধরনের হামলার ঘটনা ঘটলে তবেই কেবল যুক্তরাষ্ট্র সামরিকভাবে তার জবাব দেবে।
গত রোববার মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। (এই ধরনের কোনো হামলা হলে) যুক্তরাষ্ট্র তার সমুচিত জবাব দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাও করবে না।’
https://www.youtube.com/watch?v=R7pYw348nHs
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post