দেশে ডলার সংকট চলছে। এর পরও বেড়েছে অর্থপাচার। কখনও যাত্রীরা সরাসরি মুদ্রা দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার কখনও যাত্রীবেশে চোরাচালানি চক্র মুদ্রা পাচার করছেন। শুধু মুদ্রা নয়, দেশ থেকে রপ্তানি সামগ্রী চোরাচালান সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাচার হচ্ছে। এর বিপরীতে অর্থ দেশে আসছে না। সম্প্রতি বিমানবন্দর কাস্টমস বিদেশগামী যাত্রীদের লাগেজ তল্লাশি করে বিপুল পরিমাণ ওষুধ, টিভি পার্টস, সেমিকন্ডাক্টর, বিড়ি প্রভৃতি উদ্ধার করেছে। আবার ব্যাগেজ সুবিধায় যাত্রীরা স্বর্ণ আনছেন। এই স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এমনও যাত্রী রয়েছেন, যারা প্রতিমাসে কয়েকবার বিদেশ ভ্রমণ করছেন। সঙ্গে নিয়ে আসছেন স্বর্ণ। মূলত তারা বাহক হিসেবে কাজ করছেন। আনীত এসব স্বর্ণ ব্যাগেজ সুবিধায় নিয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব স্বর্ণের মূল্য বিদেশে কীভাবে পরিশোধ হচ্ছে, দেশ থেকে এ অর্থ যাচ্ছে, তা জানে না কেউ। এই পরিস্থিতিতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেশ চোরাচালান ও অর্থপাচার রোধে ‘অ্যান্টি মানি লন্ডারিং ইউনিট’ নামে স্পেশাল ইউনিট গঠন করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস। এই ইউনিট যেসব পাসপোর্টধারী যাত্রী ঘনঘন বিদেশে যাওয়া-আসা করে স্বর্ণ বহন করেন, তাদের তালিকা তৈরি করবে। সেই তালিকা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে দেয়া হবে। রাজস্ব সুরক্ষায় এই ইউনিট ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
এনবিআর সূত্রমতে, দেশে অর্থপাচার ও চোরাচালান বেড়েছে। বিশেষ করে যাত্রীরা বিদেশে আসা এবং বিদেশে যাওয়ার সময় বৈদেশিক মুদ্রা, নিষিদ্ধ ও আমদানি-নিয়ন্ত্রিত পণ্য চোরাচালান করছেন। কখনও বিদেশ থেকে সোনা ও মূল্যবান জিনিস যাত্রী নিয়ে আসছেন। প্রায় সময় কাস্টমসের হাতে তা আটক হচ্ছে। তবে যাত্রীরা বিদেশে যাওয়ার সময়ও চোরাচালানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা ও কোটি কোটি টাকার মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। এই তালিকায়
দামি ডলার, ওষুধ, সিগারেট, মাইক্রো চিপ, টিভি পার্টস এমনকি বিড়িও রয়েছে। যাত্রীবেশে অনেক চোরাচালানি এসব বিদেশ নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে এসব টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এসব পণ্য থেকে সরকার রাজস্বও পাচ্ছে না। যদিও এসব মূল্যবান পণ্য দেশীয় কোম্পানি রপ্তানি করলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসত। আবার কখনও যাত্রীরা, কখনও যাত্রীবেশে সোনা চোরাচালান হচ্ছে। ব্যাগেজ সুবিধায় দেশে আসছে প্রচুর স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার। সেই স্বর্ণ আবার চোরাচালানের মাধ্যমে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, রাজস্ব সুরক্ষার জন্য চোরাচালান, মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বিমানে রামেজিং কার্যক্রম পরিচালনা তথা চোরাচালান ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে একটি ‘অ্যান্টি মানিলন্ডারিং স্পেশাল ইউনিট’ গঠন করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস। ১২ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা এই বিশেষ ইউনিটে চারটি শিফটে কাজ শুরু করেছেন। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিমানবন্দর কাস্টমসের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম কমিশনার মো. মিনহাজ উদ্দিন। ১৫ অক্টোবর এ-সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়েছে। ইউনিটের সদস্যরা রামেজিং, বোর্ডিং ব্রিজ এলাকায় টহল ও চেকিং, ডিপার্চার স্ক্যানিং তদারকি, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দেয়া অন্যান্য দায়িত্ব পালন করবেন।
বিমানবন্দর কাস্টমস সূত্র জানিয়েছেন, স্পেশাল ইউনিট এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। যাত্রীদের বিদেশ ভ্রমণকালে সন্দেহভাজন হলে তল্লাশি করা হচ্ছে। এতে মুদ্রা, সিগারেট, মূল্যবান ওষুধ, মাইক্রো চিপ, টিভি পার্টস এমনকি বিড়িও আটক করা হয়েছে। বিমানের সহায়তায় চোরাচালান হয়। তথ্যের ভিত্তিতে বিমান রামেজিং বা তল্লাশি করা হয়। এই আদেশের মাধ্যমে আবার রামেজিং কার্যক্রম গতিশীল করা হয়েছে। রামেজিংয়ের ফলে দেশি-বিদেশি বিমানগুলোর মাধ্যমে চোরাচালান কমে আসবে, চোরাকারবারিরা ভীত হবেন। যাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে বলে মনে করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
কাস্টমসের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০০ যাত্রী বিদেশ থেকে আসে। প্রতি যাত্রী ব্যাগেজ সুবিধায় কর দিয়ে একটি সোনার বার ও কর ছাড়া ১০০ গ্রাম স্বর্ণালংকার আনতে পারেন। প্রতি যাত্রী ৪০ হাজার টাকা কর দিয়ে বৈধভাবে একটি সোনার বার ও ১০০ গ্রাম সোনা খালাস নেন। প্রতি যাত্রী একটি সোনার বার ও ১০০ গ্রাম স্বর্ণালংকার আনেন, যার মূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকা। একজন যাত্রী ২০ লাখ টাকার সোনা আনলে ৫০০ যাত্রী প্রায় ১০ কোটি টাকার সোনা নিয়ে আসেন। এছাড়া চট্টগ্রাম শাহ আমানত ও সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেও বিদেশ থেকে যাত্রী আসে। তারাও ব্যাগেজ সুবিধায় সোনার বার ও স্বর্ণালংকার নিয়ে আসে। শুধু স্বর্ণ নয়, ব্যাগেজ সুবিধায় মূল্যবান জিনিস আনা হচ্ছে।
কাস্টমসের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রতিদিন ব্যাগেজ সুবিধায় যাত্রীরা যে স্বর্ণ নিয়ে আসে, তার এত চাহিদা কি দেশে আছে? এই স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। যারা আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা, কর্মের প্রয়োজনে বিদেশ থেকে দেশে আসেন, সেসব প্রবাসী ব্যাগেজ সুবিধায় স্বর্ণ আনলে সমস্যা নেই। কিন্তু অনেক যাত্রীর পাসপোর্ট যাচাই করে দেখা গেছে, তারা প্রবাসী নন। কিন্তু মাসে তিন-চারবার বিদেশ গেছেন, আবার দেশেও এসেছেন। তিনিও ব্যাগেজ সুবিধায় সোনার বার ও স্বর্ণালংকার নিয়ে এসেছেন।
মূলত এই যাত্রী প্রবাসী নন। কিছু টাকার বিনিময়ে সোনা চোরাচালানের ক্যারিয়ার বা বহনকারী হিসেবে কাজ করেন তারা। এসব যাত্রীর পাসপোর্ট যাচাই করে তালিকা করছে বিমানবন্দর কাস্টমস। সেই তালিকা প্রতি সপ্তাহে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে দেয়া হবে। কর্তৃপক্ষ সেই যাত্রীর তথ্য যাচাই করে ইমিগ্রেশনের সিস্টেমে দিয়ে রাখবে। ইমিগ্রেশনে ওই যাত্রী শনাক্ত হওয়ার পর তারা কাস্টমসকে অবহিত করবে। কাস্টমস প্রয়োজনে তখন তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করবে। অনুমোদনবিহীন মুদ্রা পেলে কাস্টমস ওই যাত্রীকে আটক করতে পারে।
অপরদিকে বিমানবন্দর কাস্টমস সূত্রমতে, যেসব পাসপোর্টধারী যাত্রী বিদেশে যাওয়ার সময় বা দেশে আসার সময় কাস্টমস শুল্ক ফাঁকি, নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত পণ্য আটক করা হয়েছে। অথবা যেসব যাত্রী মুদ্রা পাচার, চোরাচালানের সময় আটক হয়েছেন। চোরাচালানের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন, মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ ধরনের ২১ পাসপোর্টধারী যাত্রীর একটি তালিকা ও একটি চিঠি বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে দিয়েছে বিমানবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
গতকাল বুধবার কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মো. মিনহাজ উদ্দিন সই করা তালিকাসহ চিঠি দেয়া হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী পাসপোর্টধারী যাত্রীরা বিদেশ ভ্রমণকালে বিমানবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার অনুরোধ করা হয়। একইসঙ্গে এসব যাত্রী গত এক বছরে কোন কোন দেশে কতবার ভ্রমণ করেছেন, তা জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়। এসব যাত্রীর মাধ্যমে অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা পরিবহন ও পাচারের ঝুঁকি রয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
যোগাযোগ করা হলে এনবিআরের এক সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, কাস্টমস হাউসের এটি ভালো উদ্যোগ। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কাস্টমসের এখতিয়ারাধীন বিষয়। দেশে ডলার সংকট রয়েছে। এর মধ্যে চোরাচালান ও মূল্যবান জিনিসের মাধ্যমে অর্থপাচার হয়ে যাচ্ছে। স্পেশাল এই ইউনিটের কাজ ফলপ্রসূ হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post