প্রবাসীদের ঋণ দেয়ার জন্য ২০১১ সাল থেকে কার্যক্রমে আসে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। কিন্তু জনবল ও প্রযুক্তিসহ নানান সংকটে ধীর গতিতে চলছিল ব্যাংকের কার্যক্রম। এখনো শূন্য রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদ। ফলে এখনো রেমিট্যান্স পাঠানোর কোনো কার্যকমেই যেতে পারেনি ব্যাংকটি। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন মো. মজিবর রহমান।
তিনি গত বছরের সেপ্টেম্বরে এ ব্যাংকটির দায়িত্ব নেন। এর আগে তিনি সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ডিএমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ২৩ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে তিনি তার দক্ষতার ছাপ রেখে গেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। তার যোগদানের এক বছরে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সার্বিক সূচকে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থা, আগামীর পদক্ষেপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন মো. মজিবর রহমান।
গণমাধ্যম : প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে দায়িত্ব নিয়েছেন এক বছর। এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যেও কিভাবে ব্যাংকটিকে টেনে তোলার চেষ্টা করছেন?
মো. মজিবর রহমান : যোগদানের পরে প্রতমেই খুঁজে বের করেছি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে লোকবল সংকট। লোকবল সংকট দূর না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকের আর্থিক উন্নতি করা সম্ভব না। বাজারে অনেক ব্যাংক রয়েছে তাদের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে কাজ করতে হবে।
গণমাধ্যম : এই এক বছরে ব্যাংকের কী কী পরিবর্তন আনতে পেরেছেন?
মো. মজিবর রহমান : আমি ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মাসে যোগদান করি। ওই বছরের জুনে খেলাপি ছিল ১২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। গত মাস সেপ্টেম্বরে এসে খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। প্রায় ৫ শতাংশ খেলাপি কমেছে। গত জুনে গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার ৫৩৭ জন। এর বিপরীতে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৮৩ কোটি ৭৭ লাখ। বর্তমানে ব্যাংকে গ্রাহক রয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ৭২৪ জন। এর বিপরীতে ঋণের পরিমাণ রয়েছে ২০ হাজার ৪৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা। গত ১১ বছরে ব্যাংকের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট হয়নি। আমি এসে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট চালু করেছি। এছাড়া ব্যাংকে কোন নিরাপত্তা কর্মী ও অফিস সহকারী ছিলো না। আমি ১৭৬ জন নিরাপত্তা কর্মী ও ৯৯ জন অফিস সহকারীকে নিয়োগ দিয়েছি।
গণমাধ্যম : প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ছিল রেমিট্যান্স সংগ্রহ। কিন্তু এত বছরেও তা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে আপনি কোন উদ্যোগ নিয়েছেন কী?
মো. মজিবর রহমান : প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে আনার প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন। শিগগিরিই এই ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি রেমিট্যান্স আনা সম্ভব হবে। সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। সেখানে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সব গ্রাহক সোনালী ব্যাংকে সব শাখা থেকে ঋণের কিস্তি নিতে পারবে।
গণমাধ্যম : প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ঋণ পেতে গ্রাহকের কোনো জামানত লাগে কী?
মো. মজিবর রহমান : বাংলাদেশে একমাত্র ব্যাংক প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক যে ঋণ পেতে কোনো জামানত লাগে না। এ ব্যাংকে ঋণ পেতে কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হয় না। পাসপোর্ট, ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিশন ঠিক থাকলে আবেদনের সাত দিনের মধ্যেই ঋণ দেয়া হয়। তবে তিন দিন বা আরো কম সময়ের মধ্যেও ঋণ পেয়ে থাকে গ্রাহকরা। তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশিও দেয়া হয়। তবে কেউ চাইলে ১ লাখ বা ৫০ হাজার টাকাও ঋণ নিতে পারেন। ঋণের মেয়াদ ২ বছর। এর সুদের হার ৯ শতাংশ।
গণমাধ্যম : এ ব্যাংকের গ্রাহক হলে তিনি কোন কোন সুবিধা পাবেন?
মো. মজিবর রহমান : বিদেশে যারা যান তাদের সবাই সফল হন- এমনটি নয়। অনেকে নি:শ্ব হয়েও ফিরে আসেন। যারা খারাপ অবস্থায় ফিরে আসেন তাদেরকেও ঋণ দিয়ে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। আর যারা সফল হয়ে ফিরে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চায় তাদেরও ঋণ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া কেউ যদি ঋণ নিয়ে কোন কিস্তি পরিশোধ না করেই কোনো দুর্ঘটনা বা কোনো কারণে মৃত্যুবরণ করেন, তাকে সম্পূর্ণ ঋণ মওকুফ করে দেয়া হয়। ব্যাংকগুলোর মধ্যে শুধু প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকই গ্রাহক ঋণ নেয়া অবস্থায় মারা গেলে পরিবারের আর কারো ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয় না।
গণমাধ্যম : কোন কোন দেশে যাওয়ার জন্য ঋণের আবেদন বেশি আসে?
মো. মজিবর রহমান : সৌদি আরব ঋণের আবেদন বেশি পাওয়া যায়। এরপরে দুবাই। এছাড়া সাধারণত কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন এসব দেশে গমনে ইচ্ছুক ব্যক্তিরাই বেশি আবেদন করেন। সম্প্রতি ইতালি, রোমানিয়া, জর্ডান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়া যাওয়ার ক্ষেত্রেও ঋণের আবেদন বাড়ছে।
গণমাধ্যম : ঋণ পেতে কী কী কাগজপত্র লাগে?
মো. মজিবর রহমান : বিদেশ যাওয়ার জন্য ঋণ পেতে চাইলে বৈধ ভিসা থাকা হচ্ছে অন্যতম শর্ত। ঋণের জন্য আবেদন করতে কোনো টাকা লাগে না। আবেদন করতে হয় ব্যাংকের নির্ধারিত ফরমে। বৈধ ভিসার পাশাপাশি বিদেশগামী কর্মীকে যে কোম্পানি কাজ দেবে বা নিয়োগ করবে, সেই কোম্পানির দেয়া নিয়োগপত্র লাগবে। সেই সঙ্গে আবেদনকারীর সত্যায়িত ৫ কপি পাসপোর্ট আকারের ছবি, বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা সংবলিত পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নেয়া সনদ, পাসপোর্ট ও ভিসার কপি, ম্যান পাওয়ার স্মার্ট কার্ডের ফটোকপি এবং দাখিল করতে হয়। ঋণ গ্রহণের প্রয়োজনীয় কিছু খরচ রয়েছে। সব মিলে এক লাখ টাকার জন্য ১১৫০ টাকা ফি দিতে হবে। এছাড়া দুজন জামিনদারের এক কপি করে পাসপোর্ট আকারের ছবি, এনআইডি, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানাসংবলিত পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নেয়া সনদ লাগে। জামিনদারদের যে কোনো একজনের স্বাক্ষর করা ব্যাংকের তিনটি চেকের পাতাও জমাও দিতে হয়। ঋণের প্রক্রিয়া শেষ করার পর প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক আবেদনকারীকে মুঠোফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়ে ঋণ অনুমোদনের তথ্য জানিয়ে দেয়া হয়।
গণমাধ্যম : কোন কোন খাতে ঋণ দিয়ে থাকেন?
মো. মজিবর রহমান : এখন পর্যন্ত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক শুধু প্রবাসীদের ঋণ দিয়ে থাকে। তাই প্রবাসীদের জন্য চারটি খাতে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এগুলো হলো, অভিবাসন ঋণ, পুনর্বাসন ঋণ ও বঙ্গবন্ধু অভিবাসী বৃহৎ পরিবার ঋণ এবং বিশেষ পুনর্বাসন ঋণ।
গণমাধ্যম : আমানত সংগ্রহের কোন ব্যবস্থা রয়েছে কী?
মো. মজিবর রহমান : জি। আমানত সংগ্রহে পাঁচটি স্কিম চালু রয়েছে। সেগুলো হলো, সঞ্চয়ী সেবা সঞ্চয় প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু ডাবল বেনিফিট স্কিম, বঙ্গবন্ধু সঞ্চয়ী স্কিম, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও বিবাহ সঞ্চয় স্কিম।
গণমাধ্যম : ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বলুন?
মো. মজিবর রহমান : প্রবাসীদের পাশাপাশি এসএমই ও কৃষি খাতে ঋণ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ নামে একটি অ্যাপ চালু করব। যাতে প্রবাসীরা বিদেশে বসেও সব ধরনের লেনদেন করতে পারে এ অ্যাপের মাধ্যমে। বর্তমানে ১২০টি শাখা রয়েছে। শাখা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। সাধারণ মানুষের ধারগোড়ায় প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক যাতে কাজ করতে পারে সেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post