ঢাকার মিরপুরের ব্যবসায়ী মো. আরিফ হোসেন সম্প্রতি জমি বিক্রি করেছেন। ভাবলেন, জমি বিক্রির টাকা খরচ না করে সঞ্চয়পত্র কিনে রাখবেন। কিন্তু সঞ্চয়পত্র কিনতে এসে জানতে পারেন, আয়কর রিটার্নের সনদ জমা দিতে হবে। শুধু সঞ্চয়পত্র নয়, বর্তমানে অনেক সেবা নিতে হলে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আগে ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর বা টিআইএন সনদের কপি জমা দিয়েই এসব সেবা নেওয়া যেতো। ফলে আরিফ হোসেনের মতো অনেকেই সময়মতো আয়কর রিটার্ন জমা না দেওয়ায় এ ধরনের সমস্যায় পড়েন। আয়কর রিটার্ন তৈরি করাও সহজ কাজ নয়। তাই বিভিন্ন ঝক্কি-ঝামেলার ভয়ে কর কার্যালয়ে গিয়ে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে চান না অনেকে। বর্তমানে অনলাইনেই আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া যায়।
আয়কর আইন অনুযায়ী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত ফরমে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়। করদাতার বার্ষিক আয়, ব্যয় ও সম্পদের তথ্য নির্ধারিত ফরমে উপস্থাপন করাই হচ্ছে আয়কর রিটার্ন। যাদের ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর বা টিআইএন রয়েছে, তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক। আয়কর রিটার্নে সরকার নির্ধারিত একটি ফরমে করদাতা তার আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায়ের তথ্য লিখে কর কার্যালয়ে জমা দেন। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের করদাতাদের জন্য আলাদা রিটার্ন জমা দিতে হয়।
রিটার্ন দাখিল করলেই যে আয়কর দিতে হবে, তা নয়। কারও আয় যদি করযোগ্য না হয়, তাহলে তাকে কর পরিশোধ করতে হবে না, শুধু রিটার্ন জমা দিলেই হবে। যে বছর আয়কর দেবেন, তার আগের অর্থবছর অর্থাৎ, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব করে ২০২৩ সালের আয়কর দিতে হবে।
নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশি কোনো নাগরিকের বাড়িভাড়া, চিকিৎসাভাতা ও যাতায়াত ভাতা বাদ দিয়ে বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি আয় হলেই তাকে আয়কর দিতে হয়। আয়কর দেওয়ার জন্য গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা করদাতার আয় বছরে ৫ লাখ টাকার বেশি এবং প্রতিবন্ধী করদাতার আয় ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকার বেশি হতে হবে।
কখন জমা দিতে হয়
আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় হচ্ছে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। সাধারণত প্রতি অর্থবছরের এ পাঁচ মাস জরিমানা ছাড়া বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া যায়। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যক্তি করদাতারা আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। আয়কর মেলায়ও রিটার্ন দাখিল করা যায়। রিটার্ন দাখিলের সময় করদাতা বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসেও রিটার্ন দাখিল করতে পারেন।
অনলাইনে যেভাবে আয়কর রিটার্ন
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার পাশাপাশি ঘরে বসেই সনদ, আয়কর রিটার্নের কপি সংগ্রহ করা যায়। রিটার্ন দাখিলের সময় বাড়ানোর আবেদনও করা যায়। অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার জন্য প্রথমেই etaxnbr.gov.bd লিংক বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে হবে। এবার ই-রিটার্ন অপশন নির্বাচন করে নিজের ফোন নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। নম্বরটি যাচাইয়ের জন্য ছয় অক্ষরের একটি ওটিপি কোড আসবে ফোনে।
কোডটি জমা দেওয়ার পর অ্যাকাউন্টের জন্য পাসওয়ার্ড দিতে হবে। পাসওয়ার্ড অবশ্যই শক্তিশালী হতে হবে। নিবন্ধন করার সঙ্গে সঙ্গে আপনার একটি ই-রিটার্ন অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়ে যাবে। নিবন্ধন হয়ে গেলে সাইন ইন করতে হবে। যাদের করযোগ্য আয় নেই বা ‘জিরো ট্যাক্স’, তারা প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই রিটার্ন জমা দিতে পারবেন।
যাদের করযোগ্য আয় রয়েছে, তাদের কর দিতে হবে। এ জন্য ওয়েবসাইট থেকেই জেনে নেওয়া যাবে কর বা রেয়াতের পরিমাণ, রিটার্নের সঙ্গে কত টাকা জমা দিতে হবে ইত্যাদি তথ্য। ‘প্রাপ্তিস্বীকার’ স্লিপটি ডাউনলোড করে সংরক্ষণ করতে হবে।
যে যে কাগজপত্র প্রয়োজন
টিআইএন সনদের ফটোকপি, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ১ জুলাই’ ২০২২ থেকে ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত বেতন আয়ের প্রত্যয়নপত্র/সার্টিফিকেট, ১ জুলাই’ ২০২২ থেকে ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত ব্যাংক হিসাবের বিবরণী (যদি আপনার ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয়; যেমন- সঞ্চয়পত্রের মুনাফা গ্রহণ করেন অথবা ব্যাংক হিসাবে টাকা বিদ্যমান থাকে), প্রভিডেন্ট ফান্ড/ভবিষ্য তহবিলে জমাকৃত অর্থ এবং প্রাপ্ত সুদের বিবরণী, ব্যাংকে এফডিআর বা ডিপিএস থাকলে সেটির বিবরণী, শেয়ারে বিনিয়োগ অথবা বিমার প্রিমিয়াম দেওয়া হলে তার সার্টিফিকেট, সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা থাকলে তার মুনাফা আয় এবং উৎস কর কর্তনের সার্টিফিকেট, নিজের নামে কোনো সম্পত্তি (ফ্ল্যাট, বাড়ি বা গাড়ি ইত্যাদি) থাকলে তার দলিলের কপি, ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স, ব্যবসায় বার্ষিক ক্রয়-বিক্রয় ও আয় বিবরণী এবং ব্যবসার সম্পদ ও দ্বায় বিবরণী, ব্যাংক অন্য কোনো উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করলে তার বিবরণী, অন্যান যেকোনো উৎস থেকে আয় থাকলে অথবা কর কর্তন করা হলে তার প্রমাণপত্র ও ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ব্যাংক থেকে নেওয়া রেমিট্যান্স সার্টিফিকেট।
আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সুবিধা
নির্দিষ্ট সময় আয়কর জমা না দিলে জরিমানাসহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হতে পারে। জমি নিবন্ধন থেকে শুরু করে ইউটিলিটি সংযোগ, ক্রেডিট কার্ডসহ ৪৪টি সেবা পেতে আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক। যাদের টিআইএন নম্বর আছে, তাদের অবশ্যই আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে। তবে বাৎসরিক আয় করযোগ্য না হলে কর দিতে হবে না।
অনেকেরই ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর বা টিআইএন নেই। কেউ আবার প্রথমবারের মতো টিআইএন খুলতে চাচ্ছেন। চাইলে টিআইএন তৈরি করা যায় অনলাইনে। জাতীয় পরিচয়পত্র, ফোন নম্বর বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আরজেএসসি নম্বর থাকলেই অনলাইনে আয়কর নিবন্ধন করা যাবে।
টিআইএন কীভাবে করবেন
অনলাইনে আয়কর নিবন্ধনের জন্য প্রথমেই আয়কর ওয়েবসাইটে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। অ্যাকাউন্ট নিবন্ধন হয়ে গেলে আয়কর সাইটে লগইন করে আবেদন করে টিন সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে হবে। আবেদনের জন্য প্রথমে www.incometax.gov.bd-তে প্রবেশ করতে হবে। আয়কর ওয়েবসাইটের মেনু থেকে রেজিস্ট্রার বাটনে ক্লিক করতে হবে। রেজিস্ট্রার ফরমের শূন্য ঘরগুলো প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে পূরণ শেষে রেজিস্ট্রার বাটন ক্লিক করতে হবে।
রেজিস্টার ফরমে দেওয়া আপনার ফোন নম্বরে তাৎক্ষণিকভাবে একটি কোড আসবে এবং পর্দায় থাকা ডায়ালগ বক্সে কোডটি লিখতে হবে। এরপর রেজিস্ট্রার বাটন ক্লিক করলেই টিন আবেদন করার ফরমসহ ‘ওয়েলকাম টু ট্যাক্সপেয়ার আইডেনটিফিকেশন নম্বর রেজিস্ট্রেশন/রি-রেজিস্ট্রেশন’ বার্তা দেখা যাবে। এখন লগইন অবস্থায় টিন সার্টিফিকেটের আবেদন করে তাৎক্ষণিকভাবে আয়কর সনদ ডাউনলোড করা যাবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post