মুসলিম বিশ্বের শক্তি ধারণ করে মধ্যপ্রাচ্য। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপজুড়ে মোট ১৭টি দেশ নিয়ে এর বিস্তৃতি। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান এবং ইরানে প্রচুর তেল-গ্যাসসহ অনেক খনিজ সম্পদ থাকলেও মিসর, প্যালেস্টাইন, জর্ডান এবং তুরস্কের খনিজসম্পদ তেমন নেই। বিশ্বের তেল রপ্তানিকারক দেশের সংস্থা ওপেকের অন্যতম প্লেয়ার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। ওপেক হলো বিশ্বের শতকরা ৭৩ ভাগ তেলের মালিক এবং এর থেকে বিশ্বের তেলের চাহিদার শতকরা ৪৩ ভাগ সরবরাহ করে।
অপরদিকে, পশ্চিমা দেশ বলতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে বোঝালেও জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড নীতিগতভাবে পশ্চিমা বলয়ভুক্ত। তেল-গ্যাসের মালিক মধ্যপ্রাচ্য হলেও ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং সৌদি আরবের বাদশা ফয়সালের মধ্যে করা পেট্র-ডলার চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের তেল-গ্যাস পশ্চিমারা নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। পেট্র-ডলার চুক্তির, অন্যতম শর্ত ছিল পেট্রল কেবল ডলারের মাধ্যমে বিক্রি করতে হবে এবং এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি রাজপরিবারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখবে। এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাজতন্ত্রের দেশগুলো সমর্থন করেছিল। আর এই রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি রক্ষার নামে বিভিন্ন ইস্যুতে মধ্যপ্রাচ্যকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা অশান্ত করে রাখতো।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকান বলয় থেকে বের হয়ে রাশিয়া-চায়না বলয়ের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব কমিয়ে এনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ে বর্তমান মুসলিম বিশ্বের নেতা, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তৈয়্যব এরদোগান। আরবলিগ থেকে সিরিয়ার সদস্যপদ স্থগিত করার ১২ বছর পর প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে আবার সংগঠনটিতে স্বাগত জানানো, ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে মিলমিশের আভাস অন্যতম।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে পশ্চিমাদের সরে আসায় যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণ করতে অন্য দেশগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ছে। রাশিয়া ও চীনের মতো শক্তির নেতৃত্বাধীন এই নতুন মধ্যপ্রাচ্যব্যবস্থা পশ্চিমা চাওয়া-পাওয়ার সাথে একমত নাও হতে পারে; যদিও পশ্চিম ভেবেছিল, তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে গেলে সেখানে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে; কিন্তু এটি অনস্বীকার্য যে, তারা সরে আসার পর মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা কমে এসেছে। আফগানিস্তান থেকে তাড়াহুড়া করে পশ্চিমের বিদায় দেখে এখন পশ্চিমা হস্তক্ষেপ বা উপস্থিতিকে যেকোনো জায়গার অস্থিতিশীলতার কারণ বলে মনে করে বিশ্ব। ইয়েমেনে সহিংসতা কমে আসা, চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরানের সমঝোতা এবং মোহাম্মাদ বিন সালমানের রাজনৈতিক পরিপক্বতা সে বিষয়টিকেই প্রতিফলিত করে। গাজায় ইসরায়েল ও ইসলামিক জিহাদের মধ্যে হামলার ঘটনায় মধ্যস্থতা করতে পশ্চিমারা নয়, বরং মিসর এগিয়ে এসেছে।
উদীয়মান মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ব্যবস্থাকে একটি কর্তৃত্ববাদী শান্তিবলয় হিসেবে মনে করা যেতে পারে। এ অঞ্চলটি এখন অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেছে। তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে ‘ভিশন ২০৩০’ নামে একটি মেগা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন সৌদি যুবরাজ সালমান; ব্যয় করছেন শত শত বিলিয়ন ডলার। এই মেগা প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও তেলের দাম বেশি রাখতে বদ্ধপরিকর সৌদি আরব।
সৌদি আরবের মতো ইরানও বীরদর্পে আগাচ্ছে। ইরানের রয়েছে বিশাল তেল ভাণ্ডার; সেখানেও তেলের আয় বাড়ছে ৩৫ শতাংশ। অদূর ভবিষ্যতে অস্ত্র রপ্তানিও ইরানের আয়ের একটি উৎস হতে পারে। সামরিক শক্তিতে ইরান এখন বলতে গেলে বিশ্বের সুপার পাওয়ার। যেমন স্থলশক্তির উন্নয়ন, তেমন নৌশক্তির উন্নয়ন। আকাশ শক্তিতে কিছুটা দুর্বল থাকলেও রাশিয়ার সহযোগিতায় বেশ আগাচ্ছে। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা বিশ্বমানের। শোনা যাচ্ছে, পারমাণবিক শক্তিও অর্জন করতে পারে শিগগির। তুরস্ক এখন বিশ্ব রাজনীতি, পররাষ্ট্র নীতি এবং সামরিক ক্ষেত্রে একটি ফ্যাক্টর। প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই দেশটিরও এক সময়ের হারানো অর্থনীতি ফিরে পাওয়াটা এখন সময়ের ব্যাপার।
সৌদি আরব তার একসময়ের সবচেয়ে বড় বন্ধুদেশ যুক্তরাষ্ট্র, যে দেশ কি না সৌদি রাজপরিবারকে টিকিয়ে রাখার নিশ্চয়তা দিয়ে পেট্রা-ডলার চুক্তি করেছিল, তাদের কথায় কর্ণপাত করছে না। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি সঙ্কটে পড়া ইউরোপকে সুবিধা দিতে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সৌদি আরবের ওপর চাপ দিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাতে সাড়া না দিয়ে তেলের উৎপাদন আরো কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সৌদি আরব ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ওপেক প্লাসের সদস্যরা। এতে ক্ষুব্ধ হয় যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসন ওপেক প্লাসভুক্ত তেল কোম্পানিগুলোর ওপর থেকে নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রত্যাহার করার কঠিন হুঁশিয়ারি দেয়। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তিনি বিশ্বের পাঁচটি বৃহৎ দেশের অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসে সৌদি আরবকে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন।
নতুন সদস্য আসার আগেই ব্রিকসের জিডিপি জি-সেভেনের জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে। ব্রিকসভুক্ত পাঁচটি দেশ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের এবং জিডিপির ২৫ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। ব্রিকস এখন নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের বিকল্প আনার কথা ভাবছে। ফলে বিশ্বজুড়ে ডলারের যে আধিপত্য ছিল তা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
সৌদি আরব ব্রিকসে যোগ দিলে তা কেবল এই জোটের আকার ও এর প্রভাবই বাড়াবে না, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি অর্থনৈতিক অংশীদারদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কেও প্রবেশ করবে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলো মিলে ব্রিকস ব্লকের জ্বালানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার হয়ে উঠবে। খেয়াল রাখতে হবে পশ্চিমা বিশ্বের থাবা থেকে বের হয়ে মুসলিম বিশ্ব যেন ব্রিক্সের থাবায় না পড়ে যায়।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post