মাস্কাট
ওমান উপসাগরের তীরে অবস্থিত মাস্কাট ওমানের রাজধানী এবং গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী। রুক্ষ আল-হাজার পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত এই শহরটি ওমান সালাতানাতের মাস্কাট প্রদেশের প্রাদেশিক রাজধানীও বটে। মাস্কাট শহরটি ওমানের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত। এর পশ্চিমে রয়েছে আল-বাতিনা সমভূমি আর পূর্বে রয়েছে আশ-শারকিয়া অঞ্চল। মাস্কাট শহরটি মূলত ছোট ছোট বেশ কয়েকটি শহরের সমষ্টি। প্রাচীরঘেরা পুরনো এই মাস্কাট শহরে রয়েছে রাজপ্রাসাদসমূহ। শহরের চমৎকার সব স্থাপত্য দেখার ফাঁকে সমুদ্রের ঠাণ্ডা বাতাসের স্পর্শ পেতে হেঁটে আসতে পারেন মাতরাহ কর্নিশ থেকে।
শহরের দ্বিতীয় অংশটির নাম মাতরাহ।
আসলে এটি একটি জেলেপল্লী। এই এলাকা রঙিন বাজারগুলোর জন্য বিখ্যাত। সেইসাথে এটি ওমানের একটি প্রাচীনতম শহর। একসময় এই মাতরাহ-ই ছিলো ওমানের রাজধানী।
অন্য শহরটির নাম রুই।
এই অংশটি মাস্কাট শহরের বাণিজ্যিক কেন্দ্র। তবে এই শহরকে দ্বিতীয় বাংলাদেশ ও বলে। কারণ এই শহরেই বাংলাদেশী প্রবাসীদের সবচেয়ে বেশি বসবাস। ১৯৭০ সালে সুলতান কাবুস সিংহাসনে আরোহণের পর মাস্কাটে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়। মাস্কাট থেকে শহরের প্রধান হাইওয়ে সুলতান কাবুস হাইওয়ে ধরে গেলে পথে পড়বে কুরুম, এটি মূলত বর্তমানে ওমানের কূটনৈতিক ও মিনিস্ট্রি অঞ্চল হিসেবেই বেশি পরিচিত। এরপর মদিনা আল সুলতান কাবুস, আল খোয়ের, আল-সিব, আল-হিল, আল-খুদ প্রভৃতি স্থান। তবে মূল মাস্কাট শহরেই দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই। মাস্কাট শহরটি চমৎকার সব জাদুঘর আর পুষ্প-আচ্ছাদিত পার্কের জন্যও বিখ্যাত। শহরের সবচেয়ে বড় পার্ক ‘কুরুম ন্যাশনাল পার্ক। বাইত আল- যুবাইর’ জাদুঘরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
সাগর আর পাহাড়ের মাঝখানে আটকে থাকা মাস্কাট শহরটি প্রাচীন ইতিহাস এবং সমৃদ্ধ ইসলামী ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে এর অসাধারণ সব দুর্গ, রাজপ্রাসাদ আর মসজিদের মাধ্যমে। মাস্কাট একসময় পর্তুগিজদের দখলে ছিল। সেই সুবাদে শহরে পর্তুগিজ রীতিতে নির্মিত অনেক ভবনের দেখা মেলে। তবে শহরের স্থাপত্যগুলোতে পর্তুগিজ ছাড়াও আরব, পার্সিয়ান, ইথিওপিয়ান, ভারতীয় এমনকি আধুনিক পাশ্চাত্য ধাঁচও চোখে পড়ে। আল আলম স্ট্রিটে রয়েছে পর্তুগিজদের তৈরি দু’টি দুর্গ-আল জালালি দুর্গ এবং আল মিরানি দুর্গ। এই দুর্গ দু’টির মাঝখানে অবস্থিত ‘আল আলম প্যালেস’ রাজপ্রাসাদ। নীল আর সোনালি স্তম্ভের অনিন্দ্যসুন্দর এই প্রাসাদটি ওমান সালতানাতের সুলতানের অফিস। প্রাসাদটি একদম আরব সাগরের কোল ঘেঁসে নির্মাণ করা হয়েছে।
সুলতান কাবুস গ্র্যান্ড মসজিদ
মাস্কাটের পশ্চিমাংশে অবস্থিত এই মসজিদটি সুলতান কাবুসের শাসনামলের ত্রিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে নির্মিত হয়। দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব এর মেঝেতে বিছানো পার্সিয়ান কার্পেটটি। এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্পেট। মসজিদটির রয়েছেপঞ্চাশ মিটার উঁচু সুদৃশ্য গম্বুজ এবং ইসলামের পাঁচটি খুঁটির প্রতিনিধিত্বকারী পাঁচটি মিনার। সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি এই মসজিদের ভেতরের চত্বরে রয়েছে মনোরম বাগান। দেয়ালে খোদিত কুরআনের আয়াত এর অভ্যন্তরীণ সজ্জাকে আরও মহনীয় করে তুলেছে।
শহরের গরমে অতিষ্ঠ হলে অবগাহন করতে পারেন সমুদ্রের নীল জলে। সমুদ্র স্নান বা রৌদ্রস্নান ছাড়াও উপভোগ করতে পারেন স্কুবা ডাইভিং, ট্রেকিং, রক ক্লাইম্বিং প্রভৃতি। আর যদি সৈকতে হাঁটার ইচ্ছে থাকে, বা বসে বসে সাগর-পাড়ের হাওয়ায় শরীর জুড়াতে ইচ্ছা করে, তাহলে যেতে পারেন আল কুরুম সৈকতে বা আল বুস্তান সৈকতে। আল বুস্তান সৈকতটি বিলাসবহুল হোটেল আল বুস্তান প্যালেসের ব্যক্তিগত এবং শহরের সবচেয়ে দীর্ঘতম সৈকত।
রুসাইল পার্কজাবাল আল-আখদার
‘জাবাল আল-আখদার’ ‘আল-হাজার’ পর্বতমালার অন্তর্গত একটি পর্বতশ্রেণী। মাস্কাট থেকে ১৫০ কি.মি. দূরের শহর নিজুয়ার পাশে অবস্থিত। এই পাহাড়টি মূলত চুনাপাথরে গঠিত। এখানকার পাহাড়চূড়া গুলোতে প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং পাহাড়ি ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে কিছু গাছপালা জন্মে । এজন্য একে বলা হয় ‘সবুজ পর্বত’। সবুজ কথাটা শুনে যেন ঘন সবুজ গাছগাছালি বা পত্র-পল্লব-বেষ্টিত কোনো পাহাড়ি বনভূমি কল্পনা করতে যাবেন না।
এখানে গাছপালা বলতে আছে শুধু মরুভূমির কাটা গুল্ম আর কিছু ঝোপঝাড়। নিচের মরুভূমি থেকে গাছপালা বেশি আছে বলে এর নাম হয়েছে সবুজ পাহাড়। তবে এই পর্বতশ্রেণী ঘিরে রেখেছে উর্বর সাইক মালভূমি। এখানে কৃষিকাজের উপযুক্ত জমিগুলোতে চাষাবাদ হয়। ডালিম, এপ্রিকট, পিচ বা আঙুরের মতো ফল জন্মে এখানে।
বিখ্যাত দামাস্কাস গোলাপ; Image Source: twitterএছাড়া এখানে জন্মে গোলাপি রঙের সুগন্ধি দামাস্কাস গোলাপ। এই গোলাপ থেকে তৈরি হয় এই অঞ্চলের বিখ্যাত পণ্য গোলাপজল। জাবাল আল-আখদারে রয়েছে বেশকিছু বন্যপ্রাণীর আবাস। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে অটুট রাখতে এবং বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করতে ওমানের পর্যটন মন্ত্রণালয় এই অঞ্চলকে ‘ন্যাচারাল রিজার্ভ’ ঘোষণা করেছে।
অবশ্য রুক্ষ, বিরান এই পাহাড়ে মানুষের পদধূলি কমই পড়ে। যদিও জনমানবশূন্য এই পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে চলে গেছে কার্পেটের মতো মতো মসৃণ হাইওয়ে। জাবাল আখদারে হাইকিং বেশ জনপ্রিয়। জাবাল আখদারের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে অনিন্দ্যসুন্দর সব মরূদ্যান। এই মরূদ্যান এবং পাহাড়ি চত্বরগুলোতে ঘুরে বেড়ানো যে বেশ রোমাঞ্চকর হবে, তা তো বলাই বাহুল্য। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় জাবাল আখদার ধরা পড়ে এক মহনীয় রূপে, অপার্থিব সেই সৌন্দর্য!
দুর্গ নিজওয়া ফোর্ট
ওমানের ঐতিহাসিক নিজওয়া শহরে অবস্থিত বিশাল একটি দুর্গ নিজওয়া ফোর্ট। সতেরো শতকে ইমাম সুলতান বিন সাইফ আল ইয়ারুবি দুর্গটি নির্মাণ করেন। তবে দুর্গের পুরনো অংশটি নির্মিত হয়েছিল আরও আগে, নবম শতাব্দীতে। এই দুর্গটি ওমানের দাঙ্গাপূর্ণ অতীত ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রাচীন এই স্থাপত্যটি ওমানের সবচেয়ে বেশি পরিদর্শিত স্থাপনা। এই দুর্গের প্রধান আকর্ষণ এর ত্রিশ মিটার উঁচু বিশাল চার-কোণাকৃতির টাওয়ার।
আরও পড়ুনঃ শান্তিপ্রিয় একটি দেশের নাম ওমান
টাওয়ারে ওঠার জন্য রয়েছে প্যাঁচানো সিঁড়িপথ। টাওয়ারের ছাদে চারদিকে তাক করা রয়েছে চারটি কামান। এতে বোঝা যায়, কামানের গোলা না খেয়ে কিছুতেই দুর্গে অনুপ্রবেশ সম্ভব ছিল না শত্রুপক্ষের। পুরো দুর্গ এবং টাওয়ারে রয়েছে আরও বেশকিছু প্রতিরক্ষা কৌশল, যেমন- গোপন শ্যাফট, চোরাগর্ত, নকল দরজা ইত্যাদি। দুর্গটি একটি ভূগর্ভস্থ জলাধারের উপর নির্মিত হয়েছিল, যা দুর্গে নিরবচ্ছিন্ন পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতো। বর্তমানে এই দুর্গটি জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। এখানেই সমাহিত হন দুর্গের নির্মাতা ইমাম সুলতান। ওমান নিয়ে ধারাবাহিক কলামের আজ ২ পর্ব প্রকাশ করা হইলো। আগামী পর্বে ওমানের আরও দারুণ কিছু চিত্র তুলে ধরা হবে………………
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post