ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন রাশেদ আহমেদ। উচ্চশিক্ষার জন্য যাবেন জাপানে। ১৭ মার্চ টিউশন ফি জমা দেওয়ার শেষ দিন। ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জরুরি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন।
জরুরি ফি দেন আট হাজার ৫০ টাকা। কোনোভাবেই যেন পাসপোর্ট পেতে বেগ পেতে না হয় সেজন্য এক দালালকে দেন আরও আট হাজার টাকা। সেই দালালই দ্রুত ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে দেন রাশেদকে।
ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীনও হন কেউ কেউ। যেমন- এ লেভেল পড়ুয়া মাহিন অতি জরুরি ফি দিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। ১৭ মার্চের আগে তার পাসপোর্ট লাগবে। কিন্তু আবেদনে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট গ্রহণের তারিখ পড়ে ২১ মার্চ। পাসপোর্ট জরুরি হওয়ায় শরণাপন্ন হন দালালের।
ফিঙ্গারপ্রিন্ট আগে নেওয়ার জন্য দালালকে দেন সাড়ে আট হাজার টাকা। কিন্তু তিনদিন এসে ফিরে যাওয়ায় গত ১৩ মার্চ পাসপোর্ট অফিসের গেটের সামনেই ঝগড়া বাঁধান মাহিনের পরিবার ও সেই দালাল। পরে গেটে দায়িত্বরত আনসারের সহযোগিতায় মেটে তাদের ঝগড়া।
সরেজমিনে রাজধানী ঢাকার আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে একাধিক দালালের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাসপোর্ট করতে আসা মানুষের কাছ থেকে কিছু টাকা বেশি নিয়ে কাজ করে দেন তারা। টাকা দিয়ে তাদের চ্যানেল (মাধ্যম) ধরতে হয়। সেই টাকার ভাগ চ্যানেলে থাকা পাসপোর্ট কর্মকর্তারা পান বলে দাবি তাদের।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে দেশে শুরু হয় ই-পাসপোর্ট সেবা। অনলাইনে আবেদন করলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার জন্য একটি নির্ধারিত তারিখ দেওয়া হয়। সেই তারিখের আগে ফি জমা দিয়ে পাসপোর্ট অফিসে যেতে হয় আবেদনকারীদের।
ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার পর ভেরিফিকেশন শেষে অফিস থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহের তারিখ দেওয়া হয়। পাঁচ ও ১০ বছর মেয়াদি ৪৮ এবং ৬৪ পাতার ই-পাসপোর্টের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হারে ফি জমা দেওয়া ও নির্দিষ্ট সময়ে পাসপোর্ট পাওয়ার কথা থাকলেও অনেকের ক্ষেত্রেই যথা সময়ে মিলছে না পাসপোর্ট।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ৪৮ পাতার ৫ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্টের জন্য ‘অতি জরুরি পাসপোর্ট’ দুদিনে পেতে ফি দিতে হয় ৭ হাজার ৫০০ টাকা। ‘জরুরি পাসপোর্ট’ সাত দিনে পেতে ফি দিতে হয় ৫ হাজার ৫০০ টাকা। ‘সাধারণ পাসপোর্ট’ ১৫ দিনে পেতে ফি দিতে হয় ৩ হাজার ৫০০ টাকা।
এছাড়া ৬৪ পাতার ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্টের জন্য ‘সাধারণ পাসপোর্ট’ ১৫ দিনে পেতে ফি দিতে হয় ৭ হাজার টাকা। ‘জরুরি পাসপোর্ট’ সাত দিনে পেতে ফি দিতে হয় ৯ হাজার টাকা। অতি ‘অতি জরুরি পাসপোর্ট’ দুদিনে পেতে ফি দিতে হয় ১২ হাজার টাকা।
কিন্তু বহু মানুষ আবেদন করায় ফিঙ্গারপ্রিন্টের তারিখ পড়ে কখনো এক মাস কখনো তারও বেশি সময় পর। দালাল ধরলে এই সময় তারা অনেক কমিয়ে আনেন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে। জরুরি ও অতি জরুরি পাসপোর্টও নির্ধারিত সময়ের আগেই বের করে দেন তারা। অথচ স্বাভাবিক নিয়মে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই যে কোনো সেবাপ্রার্থীর পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার কথা।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের তথ্য মতে, প্রতিদিন ওয়েবসাইটে দুই হাজার ৫৬০টি পাসপোর্টের জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আর প্রস্তুত হয়ে যাওয়া দুই হাজার পাসপোর্ট প্রতিদিন দেওয়া হয় মানুষকে। সীমিত অবকাঠামো ও লোকবলের অভাবে যেখানে পাঁচ থেকে ছয়শ জন মানুষকে সেবা দেওয়া সম্ভব সেখানে দিতে হয় আড়াই হাজার মানুষকে।
প্রতিদিন নতুন পাসপোর্ট কিংবা পুরাতন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার সেবাপ্রার্থী। তাই সাধারণ সময়ের চেয়ে অনেক পরে অনলাইনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার তারিখ পান আবেদনকারীরা। আবেদন বেশি পড়ায় দ্রুত পাসপোর্ট পেতে আবেদনকারীরা তাই খোঁজেন ভিন্ন পথ। ভিন্ন পথ মানেই টাকা। দালালের মাধ্যমে আবেদন করে বেশি টাকা খরচ করতে হয়।
তবে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের পরিচালক মো. সাইদুর রহমান বলেন, প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ হাজার আবেদন পড়ায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়ার সিরিয়াল পায় অনেক পরে। এটা সম্পূর্ণ সার্ভারের মাধ্যমে হয়। তাই এখানে আমাদের হাত নেই। চাপ বেশি পড়ায় এরই মধ্যে ঢাকায় আমরা আরও দুটি অফিস করেছি। আমরা মানুষকে সহজে সেবাটা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
গত ২১ মার্চ পাসপোর্ট অফিসের সামনে গিয়ে দেখা যায়, হাতে ফাইল নিয়ে এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলছেন ২৫-৩০ বছর বয়সী এক তরুণ। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ওই পুলিশ সদস্য চলে গেলে কথা হয় সেই তরুণের সঙ্গে। জসীম উদ্দিন চৌধুরী নামে ওই তরুণ বলেন, সরকারিভাবে আগামী মাসেই আমার কোরিয়ায় যাওয়ার সুযোগ হতে পারে।
পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছি, কিন্তু ফিঙ্গারপ্রিন্টের তারিখ পড়েছে ২৭ মার্চ। এখানে এসে দেখি অনেক দালাল। এদের কাছে টাকা দিলে মেরে দেওয়া বা পরে আরও টাকা চাইতে পারে। কিন্তু পুলিশ সদস্যকে তিন হাজার টাকা দিয়ে ধরেছি যেন কাজটা নিশ্চিতভাবেই হয়। তারা আর যা-ই হোক টাকা মেরে দিতে পারবে না।
পাসপোর্ট অফিসের সামনে যেতেই প্রতিবেদককেও পাসপোর্ট করবেন কি না তা জিজ্ঞাস করেন একাধিক দালাল। কত টাকা খরচ হবে তা জানতেই হেলাল নামে এক দালাল বলেন, নতুন পাসপোর্ট জরুরি হলে দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। এতে দিতে হবে ১৪ হাজার টাকা।
এত টাকা কেন লাগবে, ভিতরে কর্মকর্তাদের কত টাকা দেন- কথার মধ্যে এসব বিষয়ে বলতেই তিনি বলেন, ভিতরে চ্যানেল ধরে করে দেবো। কত টাকা দিতে হবে এটা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। যাকে যত টাকা বলে করানো যায়। কাজের মূল্য দিলে এরা কাজ করে দেয়। তবে তাদের (কর্মকর্তাদের) হাজার দুই টাকা দিতে হয়।
হেলাল নন, শহীদ, মো. আকবর, জামাল মন্ডল, শেফালিসহ একাধিক দালালের সঙ্গে কথা হয়। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জরুরি পাসপোর্টের জন্য তাদের দিতে হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। তবে সাধারণ হলে কিছুটা কম হলেও চলে।
এক্ষেত্রে প্রতি পাসপোর্টে দিতে হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। ব্যাংকে যে টাকা জমা দিতে হয় তার বাইরে বাকি টাকার কিছু চলে যায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে পাসপোর্ট কর্মকর্তার হাতে আর পুলিশ ভেরিফিকেশনে।
দালাল শহীদ বলেন, পাসপোর্ট করে দিতে অফিসে চ্যানেল ধরতে হয়। সেই চ্যানেলকে টাকা দিতে হয়। চ্যানেলে কে আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নাম বলা যাবে না।
প্রতিদিন প্রায় ৫০ জনেরও বেশি দালাল পাসপোর্ট অফিসের সামনে অবস্থান করেন। বিভিন্ন স্থান থেকে পাসপোর্ট করতে আসা এসব মানুষকে পাসপোর্ট করে দেওয়ার কথা বলেন। আবেদন করা থেকে শুরু করে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও পাসপোর্ট হাতে পাইয়ে দেওয়ার চুক্তি করেন তারা।
এসব দালালের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না তা জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এটা আমি বলতে পারবো না।
শুধু পাসপোর্ট অফিসেই নয়, নতুন পাসপোর্ট করতে টাকা দিতে হয় পুলিশকেও। ভেরিফিকেশনের জন্য দেওয়া হয় এ টাকা। ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ হাজার টাকাও দিতে হয় আবেদনকারীদের।
চাঁদপুর জেলায় বাড়ি আব্দুল আহাদ নামে এক ব্যক্তির। ঢাকায় ফুফুর বাসার ঠিকানা দিয়ে পাসপোর্ট করেছেন। ৮ হাজার ৫০ টাকা ব্যাংকে জমা দিলেও তার খরচ হয়েছে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা।
এর মধ্যে পুলিশ ভেরিফিকেশনেই দিতে হয়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। তিনি বলেন, আমার নামে কিছু ভুল ছিল। এজন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনে আমাকে বেশি টাকা দিতে হয়েছে যেন ভেরিফিকেশন আটকে না যায়।
ঢাকার সাভারে থাকেন মাহমুদুল হাসান। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়া মাহমুদুল বিদেশে যাওয়ার জন্য করেন পাসপোর্ট। নিজেই অনলাইনে আবেদন করেন। নিয়ম অনুযায়ী সব করলেও ভেরিফিকেশনের জন্য দিতে হয় এক হাজার টাকা।
তিনি বলেন, পুলিশ আমাকে ফোন দিয়ে থানায় যেতে বলেন। আমার কাগজপত্র সব দেখে একটা ফোন নম্বর দেন। ভেরিফিকেশনে কোনো সমস্যা হলে ফোনও দিতে বলেন। তারপর খরচ ও যাতায়াতের জন্য এক হাজার টাকা তাকে দিয়ে এলাম।
মিরপুরের বাসিন্দা মো. সোহানুর রহমান সোহানকে ভেরিফিকেশনের জন্য মিরপুর মনিপুরী স্কুলের সামনে কাগজপত্র নিয়ে দেখা করতে বলেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য।
তিনি বলেন, একটি রেস্টুরেন্টে বসে আমার কাছ থেকে সব কাগজ দেখে নিলো। তারপর তার সহযোগী দুই হাজার টাকা চাইলো। আমি বললাম আমার কাছে এত টাকা নেই। তখন আমার কাছে এক হাজার টাকা ছিল সেটা দিয়ে চলে এলাম।
সূত্র: জাগো নিউজ
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post