বিশ্ব কূটনীতিকে প্রভাব বিস্তার করা অন্যতম একটি দেশ তুরস্ক। গুরুত্বপূর্ণ পানিপথ বসফরাস প্রণালী ছাড়াও ইউরোপ এশিয়াকে সংযুক্ত করেছে অটোমান সমাজ্র গড়ে তোলা এই ভূখণ্ড। আগামী ১৪ মে দেশটিতে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই ভোটে দীর্ঘ দুই দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা এরদোয়ান আবার ক্ষমতায় আসবেন নাকি নতুন ইতিহাস লিখবে তুর্কিরা?
তুরস্কে সাধারণ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, জনমত জরিপে অবস্থান ততই শক্ত হচ্ছে বিরোধী প্রার্থী কেমাল কিলিচদারুগলুর। দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানকে কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলা কেমালকে ভাবা হচ্ছে আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের প্রতিনিধি হিসেবে।
একের পর এক সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন এরদোয়ান। নির্বাচনী প্রচারণায় চষে বেড়াচ্ছেন পুরো দেশ। নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে যেন নবজোয়ার এনেছেন ৬৯ এর ‘বুড়ো’ এরদোয়ান। জানান দিচ্ছেন চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতার। লাখো মানুষ এরদোয়ানকে বরণ করে নিচ্ছে। তরুণের মতো শক্তি নিয়ে জনসংযোগ করছেন এরদোয়ান। অপরদিকে থেমে নেই বিরোধী প্রার্থীও।
এরদোয়ানের সমাবেশে জনজোয়ার দেখা দিলেও আগের ভোটের মতো এবারের ভোট যে সহজ হবে না তা জানেন এরদোয়ানও। ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির কারণে তুরস্কের অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। জিনিসপত্রের দাম আকাশে উঠেছে। প্রচুর সংখ্যক তুর্কী নাগরিক দেশটিতে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির জন্য এরদোয়ানকে দায়ী করেন। কারণ তিনি ব্যাঙ্কের সুদের হার বাড়াতে রাজি হননি। বর্তমানে তুরস্কে সরকারিভাবে মূল্যস্ফীতির হার ৫০ শতাংশের বেশি। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন এই হার আসলে ১০০ শতাংশেরও বেশি।
মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে সম্প্রতি ভয়াবহ ভূমিকম্প। প্রায় অর্ধলাখ মানুষের মৃত্যু এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেকোনও দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারে নিমেষেই। অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই এমন ভূমিকম্প এরদোয়ান সরকারকে ঝড়ে নড়া লম্বা গাছের মতো অবস্থায় নিয়ে এসেছে। অপরদিকে যুদ্ধের ময়দানে দুর্ভেদ্য এক বর্ম হাতে পেয়েছে বিরোধী দলগুলো।
তুরস্কে ৬ই ফেব্রুয়ারির এক জোড়া ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরে এরদোয়ানও তার নেতৃত্বাধীন শাসক দলের ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। তার সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে সরকার উদ্ধার তৎপরতা চালাতে ব্যর্থ হয়েছে। তুর্কি সরকারের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ উঠেছে যে নির্মাণ খাতে বড়ো ধরনের অনিয়মের কারণেই ভূমিকম্পে এতো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ভূমিকম্পে তুরস্কের ১১টি প্রদেশের লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে। এরদোয়ানের প্রতি প্রচুর সমর্থন থাকার কারণে এসব প্রদেশের কয়েকটিকে তার পার্টির ঘাঁটি হিসেবে দেখা হতো। ধারণা করা হচ্ছে- এসব প্রদেশের ওপরই এরদোগানের জয় পরাজয় নির্ভর করছে।
নির্বাচনে যতো ভোট পড়বে, কোনো প্রার্থী যদি তার ৫০ শতাংশের বেশি পান, তাহলে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। এরকম না হলে নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পর সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া এখানেই এরদোয়ানের চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। তেমনটি না হলে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হবে।
রাজনীতিবিদ বা নেতা হিসেবে এরদোয়ান ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার ধারেকাছেও নেই কেমাল কিলিচদারুগলু। বাস্তবে এমনটি হলেও চিন্তার বিষয় অন্য। তুরস্কে এমন ৫০ লাখ নতুন ভোটার এই নির্বাচনে ভোট দেবেন, যারা এরদোয়ান ছাড়া আর কারও শাসন দেখেননি। পাশাপাশি তারা আধুনিক এবং তরুণ। তাদের বেশিরভাগই চান না এরদোয়ান আবার জিতুক। তারা চান- ভিন্নতা। এরদোয়ানকে ভালো নেতা হিসেবে দেখলেও তারা আরও আধুনিক তুরস্ক ও পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কের আরও উন্নয়ন চান। তাদের মতে- এটি এরদোয়ানের সময় খুব একটা সম্ভব নয়।
কোন্ডা পোলিং ইনস্টিটিউটের গবেষক এরমান বাকিরসি বলেছেন, ‘তরুণদের মধ্যে এরদোয়ানের ভোট কম, কারণ প্রথমবার ভোটাররা গড় ভোটারদের তুলনায় বেশি আধুনিক ও কম ধার্মিক। ২০০৩ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকার কারণেও এরদোয়ানকে আর চান না অনেকে। এছাড়া তুরস্কের নতুন আইন অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা একচ্ছত্র। এটিও সাধারণ মানুষের পছন্দ নয়। এটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বিরোধী দলগুলো।
এরদোয়ানের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বহুমুখী ছয়টি বিরোধীদল একতাবদ্ধ হওয়া। তাদের নেশন্স এলায়েন্স জোট কেমাল কিলিচদারুগলুকে প্রার্থী করেছে। ৭৪ বছর বয়সী কেমাল কিলিচদারুগলুকে একজন ‘সজ্জন ও পণ্ডিত’ ব্যক্তি বিবেচনা করেন অনেকে। প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি বা সিএইচপির প্রধান তিনি। কিলিচদারুগলু একজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। তিনি তুরস্কের আলেভি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য।
কিলিচদারুগলু বলছেন, জিতলে যেকোনও মূল্যে তিনি তুরস্কে গণতন্ত্র ও মুক্তি আনবেন। তিনি জানান, ‘তরুণ সমাজ গণতন্ত্র চায়। তারা চায় না- একটি টুইট বার্তা পোস্ট করেছে, শুধু সেকারণে ভোর সকালে তাদের দরজায় পুলিশ হানা দিক।’ অপরদিকে সমাবেশে হুঙ্কার দিচ্ছেন এরদোয়ানও। বিরোধীদের তোপ দেগে তিনি বলেন, ‘নেশন অ্যালায়েন্সের লক্ষ্য হলো- তুরস্ককে এমন একটি গর্তের মধ্যে ফেলে দেওয়া, যেখান থেকে অন্তত আগামী ৫০ বছরে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব না হয়।’
তুর্কি নেতা বলেন, ‘আমরা যদি তুরস্ককে আজকের পর্যায়ে না আনতাম, আপনারা নিশ্চিত থাকুন, কেউ আমাদের ব্যাপারে কোনো আপত্তি করতো না। আমরা টার্গেটে (লক্ষ্য) পরিণত রয়েছি এ কারণে যে, আমরা লড়াই করাকে বেছে নিয়েছি, আত্মসমর্পণ নয়। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চ্যালেঞ্জের হলেও পার্লামেন্টে এরদোয়ানের একে পার্টির জোট পিপলস এলায়েন্স জিতবে বলে বিভিন্ন জরিপ বলছে। যদিও এসব জরিপের ফলের ওপর খুব একটা ভরসা করা যায় না।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে এরদোয়ান সমর্থকরা বলছেন- এরদোয়ানের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার কাছে ভেসে যাবেন কেমাল কিরিচদারুগলু। অপরদিকে বিরোধীরা বলছেন, অঘটন ঘটাতে পারবেন কেমাল। কিন্তু আসলেই তুর্কিরা কী চান তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আর কয়েকটা দিন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post