বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে একুশ শতকের করোনা ভাইরাস মহামারি এই – পুরো পাঁচ দশকেই কোনো না কোনো ভাবে আলোচনায় এসেছেন ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বাংলাদেশে অনেকেই যাকে সম্বোধন করেন গরীবের ডাক্তার হিসেবে।
যুদ্ধকালীন সময়ে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। স্বাধীনতার পর বিলাতে না গিয়ে দেশেই সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে শুরু করলেন। তার প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য -ধীরে ধীরে সারা বিশ্বের স্বীকৃতি পায়।”
ইংল্যান্ডে থাকার সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রকাশ্যে পাকিস্তানী পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে বিশেষ অনুমোদন নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। চিকিৎসক পরিচয় ছাপিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন সংগঠক, চিন্তাবিদ ও জাতির বিবেক।
আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তান হওয়ায় ছাত্রজীবন কেটেছে বিলাসিতায়। তবে মুক্তিযুদ্ধ আমূল বদলে দেয় গণস্বাস্থ্যের এই পথিকৃৎকে। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ব্যাপকভাবে নাড়া দেয় তাকে।
সেই থেকে বদলে ফেলেন জীনবনযাত্রা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে তার পরনের শার্ট ও প্যান্ট। সাদা ও হালকা বেগুনি চেকের সেই শার্ট পরেছেন টানা ৩০ বছর।
সেলাই করা এক স্যুটেই কাটিয়ে দিয়েছেন বছরের পর বছর। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তালি যুক্ত প্যান্ট পরিধান করেছেন দেশের এই গুণী মানুষটি। অথচ তিনি চাইলে বিশ্বের সবচেয়ে দামী গাড়ি এবং দামী পোশাক পরিধান করতে পারতেন।
জীবনী ঘেঁটে জানা যায়, লন্ডনে চিকিৎসাবিদ্যা পড়ার সময়ে ব্রিটিশ রাজপরিবারের দর্জি বানাতেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্যুট। রাজকীয় দর্জি বাসায় এসে মাপ নিয়ে যেত তার।
এ জন্য বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতেন তিনি। ছিল বিমান চালনার প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স। অথচ সেই মানুষটির দেশে-বিদেশে কোনো ফ্ল্যাট নেই। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পদও দান করে গেছেন।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এক গণমাধ্যমকর্মীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সহজ-সরল জীবনযাপনের ব্যাখ্যা দেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেছিলেন, ‘যে দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় খালি পায়ে হেঁটেছে, সেখানে এটি তো সাধারণ ব্যাপার।
আমার শার্টের বয়স প্রায় ৩০ বছর। এই শার্ট যদি না ছিঁড়ে, আমি কি ছিঁড়ে ফেলব? লন্ডনে থাকা অবস্থায় সেখানকার রাজপরিবারের প্রিন্স চার্লস যে টেইলারে স্যুট সেলাই করতেন, আমার স্যুটও দর্জি সেলাই করে দিত। এসে জামার মাপ নিয়ে যেত।’
দেশের মানুষকে স্বল্প খরচে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার উপায় নিয়ে সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এ জন্য নিজ উদ্যোগেই করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি সাশ্রয়ী মূল্যে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।
তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন দেশের ভালোর জন্য কিছু করার। চেষ্টা করেছেন নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার। মরণোত্তর দেহদানের মাধ্যমে নিজের শরীরকেও তিনি মানুষের কল্যাণেই বিলিয়ে দিয়ে গেছেন।
তিনি পুরোটা সময় দেশ ও মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন। নিজের ক্যারিয়ারের চেয়ে দেশপ্রেমকে প্রাধান্য দিয়েছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া এই মহান মানুষটি।
ডা. জাফরুল্লাহর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে। তার বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্যসেন। পিতামাতার ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। করোনা চিকিৎসায় দামি ওষুধ গ্রহণ করতে রাজি হননি।
তার কথা ছিল, ‘প্রথমত করোনা চিকিৎসায় এত দামি ওষুধ দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, যে ওষুধ কেনার সামর্থ্য সাধারণ মানুষের নেই, সেই ওষুধ আমি খাব না।’ কোনো ডাক্তার তার মত পরিবর্তন করাতে পারেননি।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত ধূমপান করা যাবে না। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং তার চাকরির মেয়াদ শেষ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরির মেয়াদ বাড়ালেন না। ড. ওয়াজেদ মিয়া দেখা করলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হতে চান। সমস্যা হলো ধূমপান।
ড. ওয়াজেদ মিয়া প্রচুর ধূমপান করতেন। এক মাস সময় নিয়ে পরিপূর্ণভাবে ধূমপান ছেড়ে দিয়ে বিজ্ঞান উপদেষ্টা হিসেবে তিনি যুক্ত হন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে। অর্থাৎ কখনই তিনি নীতির সাথে আপোষ করেননি।
দীর্ঘদিন ধরে কিডনি বিকল ছিল ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। বেঁচে থাকতে নির্ভর করতেন ডায়ালাইসিসের ওপর। বিদেশি বন্ধুরা বিদেশে বিনা পয়সায় কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিলেও নিতে রাজি হননি তিনি।
জীবনের শেষ মুহূর্ত গণস্বাস্থ্যেই চিকিৎসা নিয়েছেন। ১১ এপ্রিল রাত ১১টায় রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। শারীরিকভাবে তিনি নেই। তবে তার গড়া প্রতিষ্ঠান আছে, থাকবে। জনগণের ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। জনগণই তাদের প্রয়োজনে টিকিয়ে রাখবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post