জানুয়ারিতে আবুধাবির সাগরতীরের একটি প্রাসাদে সংযুক্ত আরব আমিরাত যখন মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের একটি সম্মেলন আয়োজন করেছিল, সেখানে ভ্রু কুচকে দেওয়ার মতো এক নেতা অনুপস্থিত ছিলেন: সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এক মাস আগে, রিয়াদে আয়োজিত উচ্চ পর্যায়ের চীন-আরব সম্মেলনে অনুপস্থিত ছিলেন আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। উপসাগরীয় কর্মকর্তারা বলছেন, সৌদি যুবরাজ ও আমিরাতের প্রেসিডেন্ট সচেতনভাবে একে অপরের আয়োজনে অনুপস্থিত থেকেছেন। যদিও উভয় সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জর্ডান, মিসর, কাতার ও অপর দেশগুলোর নেতারা। এই অনুপস্থিতি প্রমাণ করছে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা অংশীদার দুটি দেশের মধ্যে বিরোধ।
আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরব ও আমিরাত এখনও মিত্র। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বিরোধ বাড়ছে। বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বৈশ্বিক তেলের বাজারে প্রভাব বিস্তার এবং ইয়েমেন যুদ্ধের গতিপথ নিয়ে এই বিরোধিতা প্রকাশ পাচ্ছে। এক সময় এই বিরোধ পর্দার আড়ালে থাকলেও এখন ক্রমশ তা প্রকাশ্যে আসছে। এর ফলে জ্বালানি সমৃদ্ধ উপসাগরীয় অঞ্চলে মিত্রদের নতুন বিন্যাস দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ইরান যখন অঞ্চলটিতে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ অপরিশোধিত তেলের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। ওপেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সৌদি যুবরাজের ঘনিষ্ঠ সংযুক্ত আরব আমিরাতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা শেখ তাহনৌন বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার তিনি ৩৭ বছর বয়সী প্রভাবশালী সৌদি যুবরাজের সঙ্গে বৈঠকের চেষ্টায় রিয়াদ সফর করেছেন। কিন্তু উত্তেজনা কমাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমন সফর সম্পর্কে অবগত ব্যক্তিরা বলছেন, জানুয়ারিতে আবুধাবির সম্মেলনের পর অন্তত একবার তিনি সৌদি যুবরাজের সঙ্গে সাক্ষাতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমিরাতের ৬১ বছর বয়সী শেখ মোহাম্মদ এক সময় ছিলেন সৌদি যুবরাজের পরামর্শদাতা। কয়েক বছর আগে সৌদি আরবের মরুভূমিতে দুই নেতা রাতে সময় কাটিয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি দুই ব্যক্তির দূরত্ব বেড়েছে। বিশেষ করে নেতৃত্বের ভিশন তাদের আলাদা পথে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সৌদি যুবরাজ যে তদন্তের মুখে পড়েছেন তাতে শেখ মোহাম্মদ তাকে কিছুটা এড়িয়ে চলছেন।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক সিনিয়র উপদেষ্টা দিনা এফসানদিয়ারি বলেছেন, কয়েক বছর আগেও এমন বিরোধ ও উন্মুক্তভাবে একে অপরের বিরোধিতার কথা শোনা যায়নি। এখন তা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়ে আমিরাতি কর্মকর্তারা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সৌদি কর্মকর্তারা মন্তব্যের অনুরোধে কোনও সাড়া দেননি। ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ মোহাম্মদের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক এক আমিরাতি উপদেষ্টা আনোয়ার গার্গাশ টুইটারে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের ঐক্যের বিষয়ে পুনরায় আশ্বস্ত করেছিলেন। উপসাগরীয় মিত্রদের মধ্যে বিরোধের কথা ভুল বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
দুই দেশের সবচেয়ে বেশি বিরোধ ইয়েমেন নিয়ে। দেশটিতে সৌদি আরব ও আমিরাতের নেতৃত্বাধীন আরব সামরিক জোট ২০১৫ সালে হস্তক্ষেপ করে। গৃহযুদ্ধে দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণ করছে দেশটির উত্তরাংশ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দক্ষিণাংশ। ২০১৯ সালে ইয়েমেন থেকে নিজেদের বেশিরভাগ পদাতিক সেনা প্রত্যাহার করেছে আমিরাত। তবে দেশটি আশঙ্কা করছে ইয়েমেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হতে পারে। কারণ সৌদি আরব যুদ্ধ অবসানে হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার চেষ্টা করছে। উপসাগরীয় কর্মকর্তাদের বক্তব্যে এমনটিই উঠে এসেছে। তারা আরও বলছেন ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে কৌশলগত অবস্থান ধরে রাখতে চায় সংযুক্ত আরব আমিরাত। লোহিত সাগরে একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজেদের সমুদ্রপথ সুরক্ষিত রাখতেও চায় আবুধাবি।
গত ডিসেম্বরে সৌদি আরব সমর্থিত ইয়েমেনি সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তিতে দেশটি হুমকিতে পড়লে আমিরাতি বাহিনীর হস্তক্ষেপ, ইয়েমেনি সেনাদের প্রশিক্ষণ এবং গোয়েন্দা সহযোগিতা গভীর করার অনুমোদন দিয়েছে। লোহিত সাগরের বাব আল-মানদেব দ্বীপ প্রণালীতে একটি সামরিক ঘাঁটি ও রানওয়ে তৈরিও করতে চাইছে আমিরাত। উপসাগরীয় কর্মকর্তারা বলছেন, সৌদি আরবের কর্মকর্তারা আড়ালে এই নিরাপত্তা চুক্তি ও সামরিক ঘাঁটির পরিকল্পনা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। তারা মনে করছেন, হুথিদের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে ৮০০ মাইল সীমান্ত সুরক্ষিত করতে রিয়াদের যে প্রধান লক্ষ্য, সেটির বিরুদ্ধে কাজ করছে আমিরাত।
এই কর্মকর্তারা আরও জানান, পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে আমিরাতের অভিযানের কাছাকাছি এলাকায় আরব সামরিক জোটের সুদানি সেনাদের মোতায়েন করেছে সৌদি আরব। এটিকে আমিরাতি কর্মকর্তারা ভীতি প্রদর্শনের কৌশল হিসেবে মনে করছেন। ডিসেম্বরে শেখ মোহাম্মদ যখন রিয়াদে চীন সম্মেলনে হাজির হননি তখন সৌদি কর্মকর্তারা বলেছিলেন, তারা এটিকে ইয়েমেনে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতায় আমিরাতিদের অসন্তুষ্টির ইঙ্গিত হিসেবে বিবেচনা করছেন। শেখ মোহাম্মদের স্থলে আমিরাতের ফুজাইরা প্রদেশের শাসক চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন।
বিশ্বের বৃহত্তম দুটি তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব ও আমিরাত পর্দার আড়ালে জ্বালানি ইস্যুতেও মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। অর্গানাইজেশন অব দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (ওপেক) প্রতিনিধিরা বলছেন, সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সংস্থাটি উৎপাদন সীমিত করেছে। সংস্থার সদস্য হিসেবে আমিরাত এটি মানতে বাধ্য। কিন্তু এই সীমার চেয়ে বেশি তেল উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে আবুধাবির। এতে তাদের তেলের আয় কমছে। দীর্ঘদিন ধরেই তারা আরও বেশি তেল উৎপাদনের পক্ষে ওকালতি করে আসছে। কিন্তু সৌদি আরব এতে রাজি হচ্ছে না।
আমিরাতি কর্মকর্তারা বলছেন, ওপেক ছাড়ার বিষয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলছে। যদি সংস্থাটি ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে বিশ্বের তেলের বাজারে সংস্থাটির ক্ষমতা খর্ব হবে। কোনও পদক্ষেপ নেওয়া না হলেও কয়েক বছর ধরেই এমন আলোচনা চলছে। কিন্তু সৌদি আরবের সঙ্গে সাম্প্রতিক মতবিরোধ এটিকে আরও উসকে দিচ্ছে।
গত বছর অক্টোবরে ওপেকপ্লাস (ওপেক সদস্য ও রাশিয়াসহ আরও দশটি দেশ) অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য নাটকীয় মাত্রায় উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নিলে সৌদি আরব ও আমিরাত বিরোধে জড়ায়।
প্রকাশ্যে আমিরাত এই উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, আমিরাতিরা তাদেরকে একান্তে বলেছে ওয়াশিংটনের ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তারা উৎপাদন আরও বাড়াতে চায়। কিন্তু সৌদি আরব বিরোধিতা করেছে। এরপর থেকে পর্দার আড়ালে ওপেকপ্লাসকে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়ে আসছে আমিরাত। এসফানদিয়ারি বলেন, আমিরাতিরা উদ্বিগ্ন সৌদি আরব তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে এই আশঙ্কায়। সৌদি আরবের উদ্বেগ হলো উপসাগরে সৌদি প্রভাবের বিরুদ্ধে আমিরাত একটি হুমকি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদি-আমিরাত বিরোধ কাতারের মতো গুরুতর নয়। কাতারের সঙ্গে প্রতিবেশীরা কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও ভ্রমণ সম্পর্ক বাতিল করেছিল ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২১ সালের শুরু পর্যন্ত। এখনও যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করছে সৌদি ও আমিরাত। কিন্তু তাদের পায়ে পা মিলিয়ে পথচলার দিন শেষ হয়ে গেছে।
২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এই বিরোধের সূত্রপাত। আমিরাতি কর্মকর্তারা বলছেন, ওই ঘটনায় আমিরাতিরা ভাবতে শুরু করে সৌদি আরবের কতটা ঘনিষ্ঠ থাকবে তারা তা পুনর্বিবেচনা করা হয়। ২০১৯ সালে আমিরাত ইয়েমেন থেকে সেনা প্রত্যাহার করলে সৌদি আরব নিজেদের পরিত্যক্ত হিসেবে মনে করে। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আমিরাতের চুক্তি সৌদির সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়িয়েছে।
কর্মকর্তা ও কূটনীতিকরা এর আগে বলেছিলেন, ২০২১ সালের শুরুতে রিয়াদ দ্রুত কাতারের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলায় সতর্ক হয় আবুধাবি। কাতারকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল মূলত আমিরাত এবং তারাই অবরোধ জারি রাখার পক্ষে ছিল। সৌদি আরব বিদেশি কোম্পানিগুলোর আঞ্চলিক সদর দফতর নিজ দেশে নিতে চাইছে। যা মধ্যপ্রাচ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত দুবাইয়ের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে। গত নভেম্বরে উপসাগরীয় অঞ্চলে একটি সম্ভাব্য পুনর্বিন্যাসের ইঙ্গিত হাজির হয়েছে। ওই সময় সৌদি আরবের একেবারে ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বাহরাইনের বাদশাহ আবুধাবিতে শেখ মোহাম্মদের সঙ্গে ফর্মুলা ওয়ান প্রতিযোগিতায় হাজির হয়েছিলেন। একই সপ্তাহে সৌদি যুবরাজ বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দোহাতে ছিলেন কাতারের আমিরের সঙ্গে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post