পদ্মাসেতুর পর মেট্রোরেল হলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম যোগাযোগ প্রকল্প। এর মাধ্যমে আরেকটি স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন হলো। বুধবার সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রথমবারের মতো যুক্ত হলো মেট্রোরেল। তিন ধাপে ২০২৫ সালের মধ্যে চালু হবে কমলাপুর পর্যন্ত সম্পূর্ণ মেট্রোরেল।
যানজটের নাজেহাল পরিস্থিতি থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখাচ্ছে মেট্রোরেল প্রকল্প। অবকাঠামো থেকে শুরু করে যার সবকিছুই তৈরি করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে। একইভাবে মেট্রোরেলে যারা চড়বেন তাদেরও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এর নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। স্টেশনের মেইন প্লাটফর্ম, কনকোর্স লেভেল ও ট্রেন, সবখানেই যাত্রীদের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। মেনে চলতে হবে নির্দেশিকা।
মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে মেট্রোরেল প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। জাপানের উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি হয় পরের বছর। মূল কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এ প্রকল্পের আওতায় উত্তরা (দিয়াবাড়ি) থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজ চলছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের কাজ শেষ হয়েছে।
পুরো মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পথের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এ পথে নয়টি স্টেশন রয়েছে— উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ি), উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ২৪ সেট মেট্রো ট্রেন নিয়ে শুরু হবে এমআরটি লাইন-৬ এর যাত্রা। প্রতি সেট মেট্রো ট্রেনে প্রাথমিকভাবে ছয়টি করে কোচ থাকবে। পরে আরও দুটি কোচ যোগ করে কোচের সংখ্যা আটটিতে উন্নীত করা হবে।
এলিভেটেড স্টেশন
মেট্রোরেলের উত্তরা দিয়াবাড়ি স্টেশনে সরেজমিন দেখা যায়, দোতলায় টিকিট কাউন্টার ও অন্যান্য সুবিধা রয়েছে। ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম তিন তলায়। স্টেশনে প্রশস্ত লিফট ছাড়াও এস্কেলেটরের (চলন্ত সিঁড়ি) ব্যবস্থা রয়েছে। সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ, প্রবেশপথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টিকিট সংগ্রহের মেশিনসহ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। নির্ঝঞ্ঝাট যাতায়াতে যাত্রীদের জন্য রাখা হয়েছে ‘র্যাপিড পাস’ ব্যবস্থা।
দুর্ঘটনা এড়াতে এবং যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে নিরাপত্তা বেষ্টনী বা ‘প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর’ স্থাপন করা হয়েছে। যাতে যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে ও আরামদায়ক পরিবেশে মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে পারেন। স্টেশনে ট্রেন থামার পর নিরাপত্তা বেষ্টনী ও ট্রেনের দরজা একসঙ্গে খুলে যাবে। আবার নির্দিষ্ট সময় পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হবে।
স্টেশন প্লাজার নিচে গাড়ি পার্কিং
যাত্রীরা চাইলে মেট্রোরেলের চারটি স্টেশনে নিজেদের গাড়ি সিঁড়ি বা লিফটের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারবেন। এছাড়া বাস, ট্যাক্সি, অটোরিকশা— এসব গণপরিবহনে আসা যাত্রীরাও স্টেশনের কাছে এসে নামতে পারবেন। এজন্য চারটি স্টেশন চত্বরে পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হবে। এ ব্যবস্থাকে বলা হচ্ছে স্টেশন প্লাজা। এসব স্থানে হালকা নাশতা (স্ন্যাকস) করারও ব্যবস্থা থাকবে। উত্তরা (উত্তর), আগারগাঁও, ফার্মগেট ও কমলাপুর— এ চারটি স্টেশনে প্লাজা নির্মাণ করা হচ্ছে।
সিঁড়ি, লিফট ও এস্কেলেটর ব্যবহার করে যাওয়া যাবে এপার-ওপার
মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোর সিঁড়ি, লিফট ও এস্কেলেটর ব্যবহার করে কনকোর্স লেভেল দিয়ে রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নিরাপত্তায় নিয়োজিত মেট্রোরেল সদস্যরা জানান, পেইড জোন এলাকা ও প্ল্যাটফর্মে যাওয়া যাবে না। পথচারীরা রাস্তা পারাপারের জন্য এ ব্যবস্থাকে ফুটওভার ব্রিজের অতিরিক্ত সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন।
নারী যাত্রীদের জন্য বাড়তি সুবিধা
স্টেশনগুলোতে নারী যাত্রীদের জন্য পৃথক ওয়াশরুম ও শৌচাগার তৈরি করা হয়েছে। তাতে শিশুদের ডায়াপার পরিবর্তনের সুবিধার্থে বিশেষ ব্যবস্থা সংযোজিত আছে। আলাদা কোচ রাখা ছাড়াও গর্ভবতী নারী ও বয়স্ক যাত্রীদের জন্য ট্রেনের কোচের ভেতরে আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সুবিধা
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের যাতায়াতের জন্য মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা সংযোজন করা হয়েছে। হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ও খর্বকায় ব্যক্তিরা যাতে টিকিট অফিস মেশিন (টিওএম) দিয়ে সহজে টিকিট সংগ্রহ করতে পারেন সেজন্য অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় টিকিট বুথ তৈরি করা হয়েছে। একইভাবে হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীদের জন্য টিকিট ভেন্ডিং মেশিন (টিভিএম) ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টিকিট সংগ্রহের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীদের পেইড জোনে সহজে প্রবেশ ও বের হতে হুইল চেয়ারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বয়ংক্রিয় ভাড়া পরিশোধের ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রশস্ত গেট তৈরি করা হয়েছে।
অত্যাধুনিক অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপন
সুষ্ঠু পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে একটি অত্যাধুনিক অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে উত্তরার দিয়াবাড়িতে। ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বলেন, যাত্রীদের ওঠা-নামা ও আসনে বসা— এসব বিষয়ে অভ্যস্ত ও পরিচিত করাতে প্রথমদিকে স্টেশনে ট্রেন কিছুটা বাড়তি সময় দাঁড়াবে। পরে ট্রেনের সংখ্যা বাড়বে এবং স্টেশনে দাঁড়ানোর সময় কমে যাবে। শুরুতে সব স্টেশনে মেট্রোরেল থামবে না। শুরুর স্টেশন উত্তরা উত্তর থেকে ছেড়ে ট্রেনটি পল্লবী গিয়ে থামবে। এরপর না থেমে আগারগাঁও চলে যাবে। মাঝের স্টেশনগুলোতে ট্রেন থামানোর কার্যক্রম শুরু হবে পরে।
ডিএমটিসিএল প্রকল্পে উল্লেখ করা হয়েছে, মেট্রোরেলের যাত্রীদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিতে কমিউনিকেশন বেইজড ট্রেন কন্ট্রোল (সিবিটিসি) সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে অটোমেটিক ট্রেন অপারেশন (এটিও), অটোমেটিক ট্রেন প্রটেকশন (এটিপি), অটোমেটিক ট্রেন সুপারভিশন (এটিএস) ও মোভিং ব্লক সিস্টেম (এমবিএস) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মেট্রোরেলে যাতায়াতকারী যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য সিনক্রোনাইজড প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর (ডিএসডি) অ্যান্ড ট্রেন ডোর এবং ইন্টারনেট প্রটোকল (আইপি) ক্যামেরা সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আপৎকালীন সময়ে ট্রেন থেকে বের হওয়ার জন্য জরুরি বহির্গমন দরজা রাখা হয়েছে। মেট্রো স্টেশন, রুট অ্যালাইনমেন্ট এবং ট্রেনে অনাকাঙ্ক্ষিত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা হিসেবে স্বয়ংক্রিয় স্প্রিঙ্কলার ও ওয়াটার হাইড্রেন্ট সংযোজনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
মেট্রোরেলে যাতায়াতের জন্য টিকিট কাটার দুটি পদ্ধতি থাকেছে। পদ্ধতি দুটি হলো- ‘সিঙ্গেল জার্নি টিকিট’ এবং ‘এমআরটি পাস।’ টিকিট অপারেশন মেশিন (টিওএম) থেকে টিকিট বিক্রয়কারীর সহায়তায় সিঙ্গেল জার্নি টিকিট এবং এমআরটি পাস কেনা যাবে। টিকিট ভেন্ডিং মেশিন (টিভিএম) থেকে যাত্রীরা নিজে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সিঙ্গেল জার্নি টিকিট এবং এমআরটি পাস রিচার্জ করতে পারবেন। মোবাইল ও ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন্সের মাধ্যমেও এমআরটি পাস রিচার্জ করা যাবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post