বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে টিকিট সিন্ডিকেট। অভিযোগ উঠেছে, বিমানের অসাধু কর্মকর্তারা নির্ধারিত কিছু ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগসাজশে এই সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে টিকিটের দাম বাড়াচ্ছে। বিমানের মতিঝিলের ডিস্ট্রিক সেলস অফিসের সঙ্গে ঢাকার ২৫টি ট্রাভেল এজেন্সি এবং চট্টগ্রামের তিনটি এজেন্সির সিন্ডিকেটের তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে সৌদি আরবের প্রায় দুই হাজার টিকিট। একইসঙ্গে তাদের সুবিধা দিতে ২৩ আগস্ট সৌদি আরবে পরিচালনা করা হয়েছে বিশেষ ফ্লাইট। সিন্ডিকেটভুক্ত এজেন্সিগুলো বেশি দামে এসব টিকিট বিক্রি করছে অন্যান্য এজেন্সি ও যাত্রীদের কাছে।
সূত্র জানায়, ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর সঙ্গে সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিমানের মহাব্যবস্থাপক (ডিস্ট্রিক সেলস, ঢাকা) আশরাফুল আলম। তাকে সহযোগিতা করছেন বিমানের প্রধান কার্যালয়ে বিপণন বিভাগের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) শহীদুল হাসানসহ কয়েকজন কর্মকর্তা। টিকিট বিক্রিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে বিমানকে।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিপণন এবং বিক্রয় বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব আসেন আলী আহসান বাবু। অনিয়মের অভিযোগ উঠলে ২০১৮ সালের মে মাসে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আলী আহসান বাবু চলে যাওয়ার পর ২০১৮ সালের মে মাসে এ বিভাগে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান ঢাকা জেলা সেলসের মহাব্যবস্থাপক আশরাফুল আলম। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে তাকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বিমান পরিচালনা পর্ষদ আশরাফুল আলমকে প্রথমে ওএসডি করে। পরবর্তকালে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। সে সময়ও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল— কিছু ট্রাভেল এজেন্সিকে ‘সিট ব্লক’ করে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার।
তবে আশরাফুল আলমের সুদিন আসে ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারি অতিরিক্ত সচিব আবু সালেহ মুস্তফা কামাল বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর। দুর্নীতির কারণে চাকরিচ্যুত আশরাফুল আলম আপিল করলে তাকে আবারও বিমানে যোগদানের সুযোগ দিয়ে ঢাকা জেলা সেলসের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব দেন আবু সালেহ মুস্তফা কামাল। এক বছর চার মাসের মাথায় রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশে এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় অতিরিক্তি সচিব ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামালকে।
নতুন করে বিমানের এমডি পদে দায়িত্ব পান অতিরিক্ত সচিব মো. যাহিদ হোসেন। তিনি এর আগে বিমানের পরিচালক (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) হিসেব দায়িত্বরত ছিলেন। মো. যাহিদ হোসেন একইসঙ্গে অতিরিক্ত দায়িত্বে বিমানের প্রকিওরমেন্ট ও লজিস্টিক সাপোর্ট বিভাগের পরিচালক, বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত। সিইও হিসেবে নিযুক্ত হলেও তিনি এখনও অতিরিক্তি এ দুটি বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আশরাফুল আলম আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের দুই হাজার টিকিট বিক্রি করেছেন ঢাকার ২৫টি এবং চট্টগ্রামের তিনটি এজেন্টের কাছে। জেদ্দা ও মদিনা রুটের ফ্লাইটে গ্রুপ বুকিং এর নামে সিট ব্লক করা হয়। তবে মতিঝিলের সেলস অফিস থেকে সরাসরি এসব টিকিট বিক্রির সুযোগ না থাকায় বিমানের প্রধান কার্যালয়ের বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) শহীদুল হাসানের সহযোগিতা নেন আশরাফুল আলম। অল্প সময়ে অনেক বেশি টিকিটি বিক্রি হবে, দ্রুত বিমানের আয় বাড়বে— এমন যুক্তি দেখিয়ে তারা বিমানের বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের পরিচালক ও সিইও’র কাছ থেকে বিক্রির অনুমোদন নিয়ে নেন। যদিও এই সিন্ডিকেটের তথ্য বিমানের বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে গোপন ছিল।
বিষয়টি জানাজানি হলে ২৩ আগস্টের দিকে তা ধামাচাপা দিতে বিমানের সিইও’র নির্দেশে সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করা কিছু টিকিট বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে সিন্ডিকেটের এজেন্সিগুলোকে দ্রুত সাময়িকভাবে সিটের বিপরীতে যাত্রীর নাম বসাতে বলা হয়। সিন্ডিকেটের বিষয়টি সামনে আসলেও আশরাফুল আলমের বিষয়ে নমনীয় বিমানের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
সূত্র জানায়, ওমরাহ টিকিটের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সিন্ডিকেটের ২৫ এজেন্সির কাছে বেজ ফেয়ারের দুই হাজার টিকিট বিক্রি করে দেওয়া হয়। বর্তমান সময়ে বিমানের সিস্টেমে হাই ফেয়ারের টিকিট শো করছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের টিকিট না পেয়ে ওমরাহ এজেন্সিগুলো বেকায়দায় পড়ে সিন্ডিকেটভুক্ত এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে বেশি দামে টিকিট কিনতে বাধ্য হচ্ছে। ওই এজেন্সিগুলোকে টিকিট কেনার ক্ষেত্রে যাত্রীর নাম বা পাসপোর্ট দিতে হয়নি। ফলে এখন তারা যেকোনও এজেন্সি ও যাত্রীর কাছে বেশি দামে টিকিটি বিক্রি করতে পারছে সহজেই।
বিমানের মহাব্যবস্থাপক (ডিস্ট্রিক সেলস,ঢাকা) আশরাফুল আলম বলেন, ‘মতিঝিলের সেলস অফিস থেকে আমাদের কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অথরিটি নেই। যা কিছুই করি না কেন, আমাদের প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন লাগে। এজেন্সিগুলো আমাদের কাছে তাদের টিকিটের চাহিদার কথা জানালে আমরা সেটি প্রধান কার্যালয়ে অবহিত করি। যা কিছুই মতিঝিল থেকে হয়েছে তা প্রধান কার্যালয়ের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েই হয়েছে।’
এ বিষয়ে বিমানের সিইও মো. যাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমি নিজে ২৫ আগস্ট সিস্টেমে চেক করে দেখেছি— নাম ছাড়া কোনও টিকিট বুক পাইনি। আর ২৫ তারিখের আগে নাম ছাড়া কোনও টিকিট থাকলে সেগুলো বাতিল করা হয়েছে। আমাদের ওমরাহ টিকিটের প্রাইস ছিল সাড়ে সাতশ’ থেকে ৯শ’ ডলার পর্যন্ত। আমরা গ্রুপ ফেয়ারে টিকিট বিক্রি করি। যেকোনও এজেন্সি গ্রুপ ফেয়ারে টিকিট কাটতে পারে। এখন কথা হচ্ছে, কেউ হয়তো বেশি বুকিং করতে পেরেছে, কেউ হয়তো কম। এখানে একটা বিষয়, যে এজেন্সির জনবল বেশি সে হয়তো দ্রুত অনেক বেশি বুক করতে পেরেছে।’
গ্রুপ বুকিং প্রসঙ্গে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আমরা সিস্টেমে টিকিট ওপেন করার পর যেসব এজেন্সি স্মার্টলি কাজ করে, যাদের জনবল বেশি, তারা বেশি টিকিট বুক করে রাখে। কোনও এজেন্সি কম পাচ্ছে, আবার কেউ বেশি— এখানে আমাদের কোনও হাত নেই। এজেন্সিগুলো নাম-ঠিকানা ছাড়া অনেক সময় গ্রুপ বুকিং করতেই পারে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের ওমরাহ’র সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় টিকিট কম থাকায় সমস্যা হয়েছে। এখন কোনও এজেন্সি যদি বেশি টাকা দাবি করে, আমার তো করার কিছু নেই। অন্য এয়ারলাইনও একই পদ্ধতিতে টিকিট বিক্রি করে, তাদের নিয়ে এত কথা হয় না। আমাদের টার্গেট বিমানকে লাভজনক করা।’
সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে যাহিদ হোসেন বলেন, ‘কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে হলে স্পেসিফিক প্রমাণ লাগবে।’ সূত্র বলছে, সিন্ডিকেটের খবরে অসন্তোষ প্রকাশ করে তদন্তের উদ্যোগ নিচ্ছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
আরো পড়ুন:
মারা গেলেন ওমান প্রবাসী আপন চার ভাই
‘প্রবাসীদের রেমিট্যান্স-যোদ্ধা বলে লাভ নেই’
ওমানে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মাদকের চালান ধরলো সৌদি
স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিলো বাজুস
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post