ভালোলাগা থেকে ভালবাসা, আর সেই ভালবাসার টানেই একাকী ওমানের উদ্দেশ্যে পারি জমান ৩৬ বছর বয়সী বাংলাদেশি এক নারী। সবকিছুই ঠিক চলছিল, কিন্তু হঠাত করেই জীবনের সব রং যেন বদলে যায় ওমানের মাটিতে। রঙ্গিন দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে কঠিন ও বাস্তব এক জীবনে প্রবেশের এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন তিনি।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ধলপুরের উক্ত নারী অনলাইন জগতে নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পরিচিত হন ওমান প্রবাসী রফিকুল ইসলামের সাথে। সেখান থেকে ফেসবুকের মাধ্যমে গড়ে ওঠে গভীর প্রেম। কিন্তু এই ভালোবাসা যে তার ভাগ্যকে কঠিন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন করবে তা বুঝে উঠতে পারেননি তিনি।
এক বছরেরও বেশি সময় আগে রফিকুল তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করার প্রলোভন দেখায়। একপর্যায়ে গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি তিনি একাই আড়াই লাখ টাকা নিয়ে পাড়ি জমান ওমানে। কাজের সন্ধানে গেলেও সেখানে গিয়ে তার জায়গা হয় পতিতালয়ের বন্দী অর্ধশতাধিক নারীর সাথে। এক সাক্ষাৎকারে উক্ত নারী জানান, ২ ফেব্রুয়ারি সকালে ওমানে পৌঁছালে রফিকুল তার পাসপোর্ট, ভিসার কপি, বিএমইটি কার্ড জব্দ করে আলখুদ নামক শহরের একটি বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে শ্লীলতাহানি হতে বাধা দিলে রফিকুল তাকে বিয়ে করার প্রলোভন দেখি ধর্ষণ করে। আর বন্দী রাখা হয় ওই বাড়িতেই।
বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিনিয়ত চলে শ্লীলতাহানি। বন্দী থাকায় প্রতিবাদ করার কোনো পথ খুঁজে পাননি তিনি। এভাবে প্রায় তিন মাস পার হলে রফিকুলকে চাকরি ও বিরে জন্য চাপ দিলে অবস্থা আরো শোচনীয় হয় তার। হাসপাতালে চাকরি দেবে বলে তিন জনের হাতে তাকে তুলে দেয় রফিকুল। কিন্তু হাসপাতালে না নিয়ে তাকে নেয়া হয় সিববাজারের নিকটবর্তী একটি বাড়িতে। আর এখানেই প্রতিদিন চলতে থাকে পাশবিক নির্যাতন। উক্ত নারী আরো বলেন, এভাবে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার প্রায় ২০ দিন পর রফিক তাকে দেখতে যায়। প্রশ্ন করলে রফিক তাকে মারধর করে এবং তাকে সেখানে ফেলে চলে যায়। প্রতিদিন ৩০/৩৫ জন তাকে ধর্ষণ করে যা চলে প্রায় আট মাস ধরে।
দীর্ঘদিন এই কাজের শিকার হয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে নাজিম নামের এক ব্যক্তি তাকে ওমানের বাংলাদেশ দূতাবাসে নিয়ে আউটপাস সংগ্রহ করেন। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর দেশে ফেরেন সেঁজুতি। দেশে ফিরে তিনি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, দেশে ফিরে রফিকের কাছে এই অন্যায়ের কারণ জানতে চাইলে সে ক্ষমা চায় এবং দেশে এসে বিয়ে করার ওয়াদা করে। চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি ওমান থেকে ঢাকায় ফিরে রফিক কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে যায়। এবং তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনায় আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য নানা ভয়ভীতি দেখাতে থাকে।
এ ঘটনায় একাধিকবার যাত্রাবাড়ী থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও কোন মামলা নেয়া হয় নি বলে জানান তিনি। পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সঙ্গে যোগাযোগ করলে ৩১ মার্চ যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ তার মামলা নেয়।
ভুক্তভোগী ওই নারী এবং ওমান প্রবাসীদের মতে, আর্থিকভাবে দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, গার্মেন্টস শ্রমিক এমনকি বিধবাদেরও অনেক টাকার স্বপ্ন দেখিয়ে ওমানে পাচার করা হয়। এ জন্য দালালদের মাধ্যমে টার্গেট করা হয় নারী বা তাদের পরিচিতদের। তারপর তাদের গৃহকর্মীদের চাহিদা উল্লেখ করে ই-মেইলের মাধ্যমে ভিসা তৈরি করা হয়। এভাবেই ভুক্তভোগী ওই নারীর ভিসা পাঠানো হয়। ভিসা অনুযায়ী তার বিএমইটি কার্ড রাজধানীর পল্টনের মেসার্স আলবি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড থেকে ইস্যু করা হয়। এই সূত্র ধরে কোম্পানির কর্মী আল-আমিনকে জিজ্ঞাসা করলে সে সিআইডিকে বলেন, তারা শুধুমাত্র অর্থের জন্য বিএমইটি কার্ড প্রক্রিয়াকরণ করে। ভিসার ব্যাপারে কিছুই জানেন না।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরে সৌদি আরব ও ওমানসহ বিভিন্ন দেশে ৬০ হাজারের বেশি নারী কাজ করতে গেছেন। আর প্রায় ১০ হাজার নারী বিভিন্ন কাজে ওমানে গেছেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি র্যাব-১ জানায়, তারা নারী পাচার চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। যারা গত আড়াই বছরে ১৪ জন নারীকে দুবাই, সৌদি আরব এবং ওমানে পাচার করেছে, গার্মেন্টস এবং প্রাইভেট কোম্পানিতে ভাল বেতনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে। দুবাইয়ে বসে মহিউদ্দিন ও শিল্পী এই চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। গ্রেফতারকৃত আজিজুল হক, মোসলেম উদ্দিন ও কাউসার তাদের পক্ষে দেশে কাজ করত।
বছর দুয়েক আগে দেশে জনপ্রিয় হতে শুরু করে ‘টিক টক কালচার। যার পুরোপুরি অসৎ ব্যবহারে ফয়দা লুটছে একদল নারী পাচারকারী চক্র। এই বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আরো পড়ুন:
সবাই আমার স্ত্রীকে চোরের বউ বলে আমাকে জামিন দেন
পাসপোর্ট অফিসে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য, অনুসন্ধানে দুদক
প্রবাসী বন্ডে কমছে মুনাফার হার
করোনা মোকাবিলায় ওমানের চেয়েও এগিয়ে বাংলাদেশ
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post