বিশ্বের নবম দুর্বলতম পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তির যেন শেষ নেই। পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য অফিসিয়াল ফি-র চেয়ে বেশি অর্থ তো খরচ করতে হচ্ছেই, সেইসঙ্গে আছে আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও অদক্ষ এক সিস্টেম। মোঃ ফজলুল হক নামে এক ওমান প্রবাসী গত বছরের ২৩ মে পাসপোর্ট নবায়ন করতে ওমানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে তার কাগজপত্র জমা দেন। একটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও তার অপেক্ষার প্রহর ফুরায়নি।
এদিকে বর্তমান পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে একটি বছর অতিবাহিত হয়েগেছে। বিদেশের মাটিতে অবৈধ হয়ে তাই ফজলুল হকের কাটছে দুশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠায়। প্রবাসী ফজলুল হক একা নন, পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য এরকম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন আরও হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি।
বিশ্বের নবম দুর্বলতম পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তির যেন শেষ নেই। পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য অফিসিয়াল ফি-র চেয়ে বেশি অর্থ তো খরচ করতে হচ্ছেই, সেইসঙ্গে আছে আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও অদক্ষ এক সিস্টেম।
ডিজিটাল বাংলাদেশের যুগে একটি ডিজিটাল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও ই-পাসপোর্ট পেতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। বিশেষ করে প্রবাসীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি যেসব সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার অভিযোগ করেন, সেসবের মধ্যে রয়েছে—অভিযোগের জন্য হটলাইনে যোগাযোগের যথেষ্ট চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হওয়া, জমা দেওয়ার কয়েক মাস পার হয়ে গেলেও অনলাইনে ‘পাসপোর্ট নট ফাউন্ড’ রিপ্লাই আসা, পরে জমা দেওয়া পাসপোর্ট এসে গেলেও আগে জমা দেওয়া পাসপোর্ট দূতাবাসে আসেনি দেখানো ইত্যাদি।
গত পাঁচ বছরে পাসপোর্টের চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। পাসপোর্ট অফিসের তথ্য বলছে, দিনে তারা ৩৫ হাজারের বেশি পাসপোর্ট সরবরাহ করছে। সাধারণত জরুরি আবেদনের পাসপোর্ট ২ থেকে ৭ দিন এবং সাধারণ আবেদনের পাসপোর্ট ১৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার নিয়ম রয়েছে।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরী বলেন, তারা প্রতিদিন প্রচুর পাসপোর্ট সরবরাহ করছেন। যদিও প্রতিদিন কতজন আবেদনকারীকে পাসপোর্ট দেওয়া হচ্ছে, তা তিনি জানাতে পারেননি।
কত সংখ্যক পাসপোর্ট আটকে আছে জানতে চাইলে তা-ও জানাতে পারেননি তিনি। বলেন, এই মুহূর্তে তার কাছে এ তথ্য নেই। অভিবাসী শ্রমিকদের আরেক মাথাব্যথা হচ্ছে, পাসপোর্টের জন্য সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে তাদের। অভিবাসন ব্যয় বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে পাসপোর্টের পেছনে হওয়া এই খরচ।
পাসপোর্ট প্রসঙ্গে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বলেন, ‘আমার যদি এনআইডি থাকে, তাহলে পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য কেন হয়রান হতে হবে? এটা সম্পূর্ণ অর্থহীন।’ তিনি আরও বলেন, যেকোনো মুহূর্তেই জরুরি প্রয়োজনে মানুষকে বিদেশ যেতে হতে পারে। ‘পাসপোর্ট প্রক্রিয়া সহজ করা গেলে অনেক কিছুই সহজভাবে করা যেত,’ মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘পাসপোর্ট করার জন্য সরকারি ফি হলো ৫ হাজার টাকা। এখানে পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কেন এটা? যারা বিদেশে গিয়ে রেমিট্যান্স পাঠাবে, তাদেরকে পাসপোর্ট করতে কেন হয়রানি হতে হবে?’
এই পরিস্থিতিতে পাসপোর্টের প্রক্রিয়া সহজ করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয় সরকার। সেসব উদ্যোগের একটি ছিল ২০১৯ সালে হাই-টেক ই-পাসপোর্ট প্রবর্তন। এর মাধ্যমে বৈশ্বিক ডিজিটালাইজড দুনিয়ায় প্রবেশ করে বাংলাদেশ। কিন্তু এই পদক্ষেপের কোনো সুফল এখনও পাওয়া যায়নি।
নতুন সমাধান, নতুন সমস্যা
২০১৯ সালে ই-পাসপোর্ট চালুর উদ্দেশ্য ছিল পুরোনো মেশিন রিডেবল পাসপোর্টকে (এমআরপি) প্রতিস্থাপন করা। ই-পাসপোর্ট দেওয়া হচ্ছে এনআইডির তথ্যের ভিত্তিতে। পুরোনো এমআরপি ও এনআইডির তথ্যে যদি কোনো অমিল থাকে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ই-পাসপোর্টের আবেদন বাতিল করা হয়।
এ প্রসঙ্গে বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস আগারগাঁও, ঢাকার একটি নোটিশে বলা হয়েছে, ‘পূর্বের পাসপোর্টের সাথে এনআইডি/বিআরসি-র [জন্ম নিবন্ধন সনদ] অমিল থাকলে ই-পাসপোর্টের আবেদন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিস্টেম সফটওয়ারে আটকে যায়। উক্ত আবেদনসমূহ সেন্ট্রাল ক্লিয়ারেন্স মডিউল কর্তৃক নিষ্পত্তি করা হয় বিধায় ই-পাসপোর্ট প্রাপ্তিতে বিলম্ব হয়।’
এসব ক্ষেত্রে পাসপোর্ট প্রিন্ট হয়ে না আসা পর্যন্ত আবেদনকারীকে ‘ধৈর্য সহকারে’ অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কতদিন অপেক্ষা করতে হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। অধিদপ্তরের ডিজি আরও বলেন, এ ধরনের অসংগতি প্রচুর পরিমাণে ছিল। এর ফলে বিলম্ব হয়।
সূত্র জানায়, এনআইডিতে ত্রুটির কারণে প্রায়ই অসংগতি দেখা দেয়, যার কারণে আবেদনকারীদের পাসপোর্ট পেতে ঝামেলা হয়। সংখ্যা উল্লেখ না করে সূত্র জানিয়েছে, এরকম তথ্যের অমিলের কারণে সারা দেশের পাসপোর্ট অফিসগুলোতে বিপুলসংখ্যক ই-পাসপোর্ট আটকে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে সমস্যায় পড়েছেন অনেক ভ্রমণকারী ও অভিবাসী শ্রমিক।
এনআইডিতে থাকা তথ্যের ভুলের দায় সবসময় আবেদনকারীর না-ও হতে পারে। কখনও কখনও এমআরপি পাসপোর্ট ও এনআইডি পাওয়ার সময়ই কারও কারও ঠিকানা বদলে যেতে পারে। এই মুহূর্তে এসব সমস্যা সমাধানের সহজ কোনো উপায় নেই। তবে এগুলো ছাড়া অন্যান্য সমস্যাও থাকতে পারে।
গত ১৭ এপ্রিল প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি প্রবাসী কর্মীদের জন্য পাসপোর্ট প্রক্রিয়া সহজ করার এবং যত দ্রুত সম্ভব ই-পাসপোর্ট সংক্রান্ত সব সমস্যা সমাধানের সুপারিশ করে। সুশৃঙ্খল, নিরাপদ, নিয়মিত ও দায়িত্বশীল পাসপোর্ট প্রদান প্রক্রিয়া নিশ্চিতের জন্য ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সেবাগুলোকে দ্রুত ও জরুরি করতে তাদের কার্যক্রম নিয়েও আলোচনা করা হয় বৈঠকে।
শুধু এনআইডি সবসময় পাসপোর্ট সরবরাহের ঝামেলা থেকে বাঁচাতে পারে না। কখনও কখনও এনআইডিতে সমস্ত তথ্য সঠিক থাকার পরও পাসপোর্ট পাওয়া যায় না। বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, ‘বিদেশে গমনে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের পাসপোর্ট পেতে মারাত্মক ঝামেলা পোহাতে হয়। একজন অভিবাসনপ্রত্যাশীর যদি এনআইডি থাকে, তবে কেন তাকে পাসপোর্ট ইস্যু করার আগে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য কমপক্ষে এক মাস অপেক্ষা করতে হবে?’
তিনি বলেন, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেতে অন্তত এক মাস সময় লাগে। তবে একজন ব্যক্তির পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পাওয়া নির্ভর করে তার বিরুদ্ধে মামলা আছে কি না, তার ওপর।
শ্রমিক শিক্ষাবিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটির লেবার মাইগ্রেশন গ্রুপের সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘৩২ লাখ মানুষের নামে মামলা আছে। মামলা থাকাটা পাসপোর্ট প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হতে পারে না।’ প্রবাসীদের পাসপোর্টের ক্ষেত্রে এধরণের সকল হয়রানি বন্ধে সরকারের পক্ষথেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবী জানিয়েছেন প্রবাসীরা।
আরো পড়ুন:
সবাই আমার স্ত্রীকে চোরের বউ বলে আমাকে জামিন দেন
পাসপোর্ট অফিসে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য, অনুসন্ধানে দুদক
প্রবাসী বন্ডে কমছে মুনাফার হার
করোনা মোকাবিলায় ওমানের চেয়েও এগিয়ে বাংলাদেশ
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post