সরকারের সমালোচনা করার আগে দেশের অগ্রগতি ও প্রান্তিক মানুষের বদলে যাওয়া জীবনযাত্রা দেখে আসতে সমালোচকদের পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সোমবার সকালে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অগ্রগতি পর্যালোচনাবিষয়ক দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ পরামর্শ দেন।
বক্তব্যে করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাত এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে তৈরি মন্দা ও খাদ্যসংকট মোকাবিলায় ব্যক্তিজীবন থেকে সরকারের কর্মসূচি—সবখানে অপচয় বন্ধের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
আবাদযোগ্য এক ইঞ্চি জমিও যাতে খালি না থাকে, সেটা নিশ্চিত করারও তাগিদ দিয়েছেন সরকারপ্রধান। গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় বসে অনেকে সমালোচনা করেন। তাদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, সারা বাংলাদেশেটা আপনারা একটু ঘুরে দেখুন, পরিবর্তনটা কোথায় এসেছে, কতটা এসেছে। গ্রাম পর্যায়ে একটু যোগাযোগ করলে সেটা জানতে পারবেন।’
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে দেশে সংবাদমাধ্যমের বিকাশ হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এখন সবাই কথা বলতে পারেন। টকশো করতে পারেন। ‘অবশ্য আমি জানি, অনেক কথা বলার পরে বলবেন, আমাদের কথা বলতে দেয়া হয় না, কিন্তু যখন টকশোতে কথা বলেন, কেউ আপনার মুখ চেপে ধরে না বা গলা টিপে ধরেনি।’
সবাই যার যার ইচ্ছামতো কথা বলতে পারছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সবাইকে আমি বলব, আগে বাংলাদেশটা একটু ঘুরে আসেন। গ্রাম পর্যায়ে যান, সেখানে মানুষ কোন অবস্থায় আছে, সেটা দেখে এসে তার পরে কথা বললে, আপনারা হয়তো জানতে পারবেন।’
বিদ্যুৎ ও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের ব্যয় নিয়ে সমালোচনাকারীদের জবাব দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘এখন হয়তো অনেকে সমালোচনা করে, এটা করা হচ্ছে কেন বা পরমাণু বিদ্যুৎ কেন করা হলো। এত টাকা খরচ হয়েছে।
‘খরচের দিকটা শুধু অনেকে দেখেন, কিন্তু এই খরচের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণ যে কত লাভবান হবে, আমাদের অর্থনীতিতে কতটা অবদান রাখবে, আমাদের উন্নয়ন গতিশীল হবে, মানুষের জীবন পরিবর্তন হবে, সেটা বোধ হয় তারা বিবেচনা করেন না। এটা হচ্ছে খুব দুঃখজনক।’
মন্দা মোকাবিলায় কমাতে হবে অপচয়
করোনাভাইরাস মহামারি এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে গোটা বিশ্বজুড়ে মন্দা ও খাদ্যের অভাব দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আর সে জন্য সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সারা বিশ্বব্যাপী একটা অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিচ্ছে। এমনকি খাদ্যের অভাবও দেখা দিচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে আমাদের দেশে যেহেতু আমাদের জমি আছে, মানুষ আছে, আমি ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছি, আমাদের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি থাকবে না।’
দেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকে, যার যতটুকু সামর্থ্য আছে, নিজের খাদ্য উৎপাদন করা, নিজের খাদ্য সাশ্রয় করা এবং নিজের খাদ্যকে ব্যবহার করা বা আমাদের যা আছে সবগুলো ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সবাইকে একটু সাশ্রয়ী হতে হবে।
‘আমাদের পানি ব্যবহারে, আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবহারে, আমাদের খাদ্যশস্য ব্যবহারে, প্রতিটি ক্ষেত্রে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে হবে। কারণ আমরা জানি কোভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সারা বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে বা এর একটা ধাক্কা যেসব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যার ফলে মানুষের অনেক কষ্ট হবে। ‘কাজেই সেটা যেন আমাদের দেশে না হয়, সে জন্য আমাদের দেশের মানুষকে, প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি পরিবার, সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।’
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট নির্ধারণ
এসডিজি পর্যালোচনা করে লক্ষ্য নির্ধারণের তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সবাই মিলে কাজ করলে ২০৩০ সালের আগে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। লক্ষ্যপূরণে সরকারের অর্থ সহায়তা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিলেও অপচয় ঠেকাতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এসডিজি বাস্তবায়নে আমরা নীতি সহায়তা এবং অর্থের জোগান অব্যাহত রাখব, তবে অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং অপচয় রোধ নিশ্চিত করতে হবে।’
আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগের তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে ২০৩০-এর আগেই আমরা নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হব।’ বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় এসডিজি পর্যালোচনা প্রয়োজন বলেও মনে করেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেব, সেগুলো নির্দিষ্ট করা দরকার। যেগুলো আমরা ইতিমধ্যে অর্জন করেছি, সেগুলো ধরে রাখা এবং আগামীতে আমরা কী কী অর্জন করব, কারণ এখনকার প্রেক্ষিত যথেষ্ট পরিবর্তন হয়ে গেছে।’
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘সেখানে ক্ষেত্রগুলো সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের নিতে হবে। কোনো রকম অপচয় যেন না হয়। অপচয় পরিহার করে সুষ্ঠু অর্জন যেন আমরা করতে পারি বা বাস্তবায়ন করতে পারি, সেদিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।
‘সে ক্ষেত্রে যে সমস্ত পদক্ষেপগুলো আমাদের আশু করণীয় বা এই মুহূর্তে করতে হবে, সেগুলো যেমন চিহ্নিত করতে হবে, আবার যেগুলো হয়তো এখনই প্রয়োজন নেই, একটু দীর্ঘমেয়াদি, সেগুলো আমাদের বেছে নিতে হবে। সেভাবে যদি আমরা পরিকল্পিতভাবে এগোতে পারি, তাহলে আমি মনে করি আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।’
দেশের উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, এনজিও এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিরাও সমানভাবে অংশীদার বলে মনে করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘এ সম্মেলনে সবার অংশগ্রহণ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে বেসরকারি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বেসরকারি খাতের বিকাশে তার সরকারের নেয়া পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, সরকারের পাশাপাশি দেশের উন্নয়নের বেসরকারি খাতেরও দায়িত্ব রয়েছে।
এসডিজি বাস্তবায়ন
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এসডিজি একটি বৈশ্বিক উন্নয়ন ধারণা হলেও বাংলাদেশের উন্নয়নের পথ পরিক্রমার সঙ্গে এটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে। এসডিজি প্রণয়নের প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
‘আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মতামত নিয়ে ২০১৩ সালে আমরা জাতিসংঘের কাছে মোট ১১টি অভীষ্টের প্রস্তাব করেছিলাম। এর মধ্যে ১০টি অভীষ্টই জাতিসংঘ হুবহু অনুসরণ করে।’২০১৬ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে বলেও জানান সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের সব মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দলিল এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাকে বিবেচনায় নিয়ে প্রণয়ন করেছি। সর্বশেষ গৃহীত অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাকে পরিপূর্ণভাবে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। বাস্তবায়নে কাজও আমরা শুরু করেছি।’ দেশের সব মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করাসহ সার্বিক উন্নয়নে সরকারের নেয়া উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দারিদ্র্য বিমোচন বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, এটা শুধু আমরা শহরভিত্তিক বা রাজধানীভিত্তিক করিনি। আমাদের লক্ষ্য একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে অর্থাৎ গ্রামভিত্তিক, সাধারণ গ্রামের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের পড়ে থাকা একটা মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি যাতে হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে, আমরা আমাদের সব পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি।
‘বাংলাদেশের সব মানুষ বা পরিবারগুলোকে সম্পৃক্ত করেই আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন। আমরা আমাদের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করেছি একেবারে গ্রামভিত্তিক। অর্থাৎ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গ্রামভিত্তিক হবে এটাই আমাদের লক্ষ্য।’
সরকারের নেয়া পল্লীসঞ্চয় ব্যাংক, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি, নারীর ক্ষমতায়ন, সবার জন্য বিদ্যুৎ, কমিউনিটি ক্লিনিক ও শিশুর মানসিক বিকাশ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, পরিবেশ সুরক্ষা ও বিনিয়োগ বিকাশের উদ্যোগ দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘পরিবেশ যেন সুরক্ষিত থাকে, সেদিকে আমি লক্ষ রাখি। এ কারণে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করে দিয়েছি, যেন যত্রতত্র ইন্ডাস্ট্রি করে আমাদের পরিবেশ দূষণ করতে না পারে। বিনিয়োগ আকর্ষণ করাও আমাদের লক্ষ্য। চাষ উপযোগী ভূমি রক্ষা করাও আমাদের লক্ষ্য।’
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের চেয়ার হিসেবে বাংলাদেশ মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যানের খসড়া প্রণয়ন করেছে বলেও জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘যার রূপকল্প হলো জ্বালানি খাতে স্বনির্ভরতা অর্জন এবং বাংলাদেশের পরিকল্পিত অগ্রযাত্রাকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়া।’
২০২২ সালের এপ্রিলের মধ্যে সারা দেশে ১ লাখ ৮৩ হাজার তিনটি গৃহহীন পরিবারকে বাড়ি তৈরি করে দেয়া হয়েছে বলেও জানান বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারে ৬৪০ জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে নতুন বাড়ি করে দিয়েছি। ৪ হাজার ৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে আমরা ঘরে করে দেব।’
এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের উদ্যোগ ও কার্যক্রম বিশ্ব দরবারেও সমাদৃত হয়েছে জানিয়ে টানা তিন মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতিসংঘের সব সদস্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম ৫ বছরে এসডিজি অর্জনে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি করেছে। ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমন্ট সল্যুশনস নেটওয়ার্ক আমাদেরকে এসডিজিস গ্রগ্রেস অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেছে।’
আরো পড়ুন:
সবাই আমার স্ত্রীকে চোরের বউ বলে আমাকে জামিন দেন
পাসপোর্ট অফিসে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য, অনুসন্ধানে দুদক
প্রবাসী বন্ডে কমছে মুনাফার হার
করোনা মোকাবিলায় ওমানের চেয়েও এগিয়ে বাংলাদেশ
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post