উচ্চ বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে বিনা খরচে বেকার তরুণ তরুনীদের নেয়া হয় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। এরপর তাদের মরুভুমির প্রত্যন্ত এলাকায় নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। দেহ থেকে বের করে নেয়া হচ্ছে গুরত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘের এক রিপোর্টে এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।
জাতিসংঘ বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেচাকেনায় কালোবাজারিরা ফুলেফেঁপে উঠছে। বর্তমানে সেখানে একটি কিডনি কিনতে খরচ হচ্ছে ২ লাখ ৬২ হাজার ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২ কোটি ২২ লাখ টাকা।
এছাড়া একটি হূিপণ্ড (হার্ট) কিনতে খরচ হয় ১ লাখ ১৯ হাজার ডলার। লিভার (যকৃৎ) কিনতে ব্যয় হয় ১ লাখ ৫৭ হাজার ডলার। অবৈধভাবে সংগৃহীত এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্রেতারও অভাব নেই। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচার অবৈধ বাজার।
জাতিসংঘ বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি নিয়ে গেছেন এমন অনেক ভুক্তভোগীর পরিবার পরবর্তী সময়ে আর কখনো তার খোঁজ পায়নি। এ কারণে জীবন বাঁচাতে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। অধিকাংশ অভিবাসনপ্রত্যাশী তরুণের গন্তব্য থাকে মধ্যপ্রাচ্য। বাড়তি ব্যয়ের কারণে অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় কোনো এজেন্সি যদি বিনা পয়সায় অভিবাসনের প্রলোভন দেখায়, তাহলে তা অনেকেই লুফে নেয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
আগেও এ ধরনের প্রলোভনে পড়ে বাংলাদেশী অনেক তরুণী মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়েছেন। সেখানকার ড্যান্সবারে তাদের আটকে রেখে অনেক অনৈতিক কাজে বাধ্য করেছে পাচারকারীরা। বর্তমানে দুবাইয়ের বিভিন্ন বারে অন্তত দেড় হাজার বাংলাদেশী তরুণীকে আটকে রাখা হয়েছে। তাদের অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। এসব তরুণী গুম হয়ে গেলেও পরে তাদের কাউকে আর খুঁজে বের করার কোনো উপায় নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিবাসনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়; আমেরিকা বা ইউরোপ মহাদেশের উন্নত দেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়েও অভিবাসনপ্রত্যাশী তরুণদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে মানব পাচারকারীরা। এজন্য শুরুতে আকাশপথে ভিসা পাওয়া সহজ এমন কোনো দেশে বৈধভাবে আকাশপথে নিয়ে যাওয়া হয় তরুণদের।
মানব পাচারের ট্রানজিট এসব দেশ থেকে শুরু হয় ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা। যে যাত্রায় ডিঙোতে হয় দুর্গম পাহাড় বা কয়েকশ মাইল জঙ্গল। ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগর পাড়ি দিতে হয় অনিরাপদ নৌযানে করে। কিন্তু অনেকের ভাগ্যেই গন্তব্যে পৌঁছা আর হয়ে ওঠে না। শেষ পর্যন্ত তরুণের ভাগ্যে কী ঘটে তারও কোনো খবর পাওয়া যায় না। নিখোঁজ তরুণরা যে অঙ্গ পাচারকারীদের হাতে পড়েনি, সে আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে অন্তত ৫০ লাখ। মানব অঙ্গের ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা তাদেরই টার্গেট বানায় সবচেয়ে বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে নেয়া হয়।
আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অঙ্গদাতার সম্মতিতেও ঘটে। এক্ষেত্রে মূলত হতদরিদ্র অবস্থা থেকে আসা অভিবাসীদের প্রধান লক্ষ্য বানাচ্ছে পাচারকারীরা। এমনই এক ভুক্তভোগী জয়পুরহাটের যুবক বেলাল হুসাইন (৩৫)।
২০১৫ সালে অর্থের প্রলোভনে পড়ে তিনি নিজের যকৃৎ তুলে দেন আন্তর্জাতিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারকারী চক্রের হাতে। যদিও অনেকটা নিজের অজ্ঞাতসারেই। এক পর্যায়ে এ যুবক জানতে পারেন, তিনি নিজের শরীরের মূল্যবান একটি জিনিস হারিয়ে ফেলেছেন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য বলছে, ২০১৫ সালের দিকে প্রথম সিরিয়ায় মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারের ব্যবসা শুরু হয়। এরপর প্রতিবেশী দেশ বাহরাইন, লেবানন, তুরস্কের মতো দেশে এ ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠে। এসব দেশ চিহ্নিত হয় মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবসার ‘হট স্পট’ হিসেবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post