সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসীদের কাজে ফেরাতে বিমানবন্দরে র্যাপিড পিসিআর টেস্টের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগ নিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর অক্ষমতা প্রকাশ করলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ল্যাব স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপরই কাজ পেতে তোড়জোর শুরু করে ডিএমএফআর মলিকুলার ল্যাব এন্ড ডায়াগনস্টিক।
আবেদনে নানা অসঙ্গতি থাকলেও প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দিতে তদবির করছেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। করোনা পরীক্ষার ফি ১৭০০ টাকা রাখার প্রস্তাব করে আবেদন করলেও, কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে আরও এক হাজার টাকা বাড়ায় প্রতিষ্ঠানটি।
অন্যদিকে, ৭-৮টি প্রতিষ্ঠান ২২শ টাকার মধ্যে টেস্ট-ফি নির্ধারণ করে আবেদন করলেও সেগুলোকে মূল্যয়ন করা হয়নি।
প্রায় তিন মাস বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট নিষেধাজ্ঞার পর গত ৪ আগস্ট বাংলাদেশসহ ছয় দেশের যাত্রীদের ট্রানজিট সুবিধা চালু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। শর্ত দেওয়া হয়- ফ্লাইট ছাড়ার ৬ ঘণ্টার মধ্যে বিমানবন্দরে র্যাপিড পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট থাকতে হবে। আমিরাতের এই শর্ত বাস্তবায়ন করে ইতোমধ্যে পাকিস্তান, ভারতের কর্মীরা কাজে ফেরা শুরু করেছেন প্রায় ২ সপ্তাহ আগেই।
বাংলাদেশে পর্যাপ্ত মেশিন না থাকাসহ নানা অক্ষমতা প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। র্যাপিড পিসিআর মেশিন কেনার উদ্যোগ নিলেও সেটি ‘সময়সাপেক্ষ’ বলে জানায় অধিদফতর।
এদিকে কাজে ফিরতে বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন আরব আমিরাত প্রবাসীরা। তৎপর হয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দফায় দফায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলচল কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ল্যাব স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি গঠন হয় দুটি কমিটি। প্রধানমন্ত্রীও দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে র্যাপিড পিসিআর টেস্টের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
আর কাউকে আমলেই নেওয়া হয়নি
সূত্র জানায়, কমিটির বৈঠকে বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনে আগ্রহী প্রতিষ্ঠান খুঁজতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ৪-৫টি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করে যোগাযোগ করলে পত্রিকায় আর বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়নি। এরমধ্যে থেকে ডিএমএফআর মলিকুলার ল্যাব অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে কাজ দেওয়ার তৎপরতা শুরু হয়। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ বিভিন্ন দফতরের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার পক্ষে মত দেন। যদিও ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কমপক্ষে ৮টি প্রতিষ্ঠান ল্যাব স্থাপনে আগ্রহ দেখিয়ে আবেদন করেছিল।
জানা গেছে, ডিএমএফআর-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. দ্বীন মোহাম্মদ। যদিও পরে তিনি তার শেয়ার বিক্রি করে দেন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফাইজুর রহমান। প্রতিষ্ঠানটি ২৯ আগস্ট প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর ল্যাব স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করে আবেদন করে।
৩১ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে সুপারিশ করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দেয় ঢাকায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের দূতাবাস। দূতাবাসের কোনও কর্মকর্তার স্বাক্ষরবিহীন সেই চিঠিতে বলা হয় আরব আমিরাতের স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদিত লাইফডিএক্স নামের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ রয়েছে ডিএমএফআর-এর।
আরো পড়ুনঃ
করোনা রোগীকে স্পর্শ করলেই করোনা হয় না
যেভাবে সরকারি অনুদান পাবেন প্রবাসীরা
বিদেশে মারা গেলে ক্ষতিপূরণ আদায় করবেন যেভাবে
আবেদনে যত অসঙ্গতি
সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটির আবেদনেও রয়েছে অসঙ্গতি। প্রথম দফায় আবেদনে (২৯ আগস্ট) এক রকম শর্ত ও তথ্য দিলেও পরে পরিমার্জিত আবেদন দিয়েছে তারা। প্রথমে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, অনুমতি পেলে তারা তিন দিনের মধ্যে ল্যাব স্থাপন করতে পারবে। পরে বলছে ৫-৬ দিন সময় লাগবে।
এ ছাড়া প্রথমে জানিয়েছে, দিনে এক হাজার জনের পরীক্ষা করার সক্ষমতা আছে তাদের। পরে বলছে দিনে তিন হাজার জনের পরীক্ষা করতে পারবে। এ ছাড়া তারা ৩টি আরটি পিসিআর মেশিন ব্যবহার করবে যার মধ্যে ২টি জার্মানি এবং একটি ইউএসএ’র তৈরি। কিট ব্যবহার করবে চীন ও রাশিয়ার। প্রথমে প্রতিষ্ঠানটি এই পরীক্ষার জন্য জনপ্রতি ১৭০০ টাকা করে নেবে বলেও জানিয়েছিল।
সূত্র জানায়, ল্যাব স্থাপন সংক্রান্ত বিষয়ে ৬ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে সভা হয়। তাতে ডিএমএফআর-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, তাদের ২৪ ঘণ্টায় ৪ হাজার স্যাম্পল পরীক্ষার সক্ষমতা আছে। তবে আবেদনের সঙ্গে যেসব কাগজপত্র তারা জমা দিয়েছে তাতে অসঙ্গতি আছে বলে সভায় প্রশ্ন ওঠে। বলা হয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দূতাবাসের সুপারিশের চিঠি যথাযথ মাধ্যমে আসেনি। এ ছাড়া, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও পায়নি। অন্যদিকে দূতাবাস চিঠি দিয়ে সুপারিশ করলেও প্রতিষ্ঠানটিকে আরব আমিরাত সরকার সুপারিশ করেছে কিনা এসব প্রশ্ন উঠলে কোনও জবাব দিতে পারেনি ডিএমএফআর।
প্রতিষ্ঠানটি দুবাইয়ের ‘পিউর হেলথ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি আছে দাবি করে আবদেন করলেও পরে তারা বলছে ‘লাইফ ডিএক্স’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কথা। যদিও এ দাবির পক্ষে কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটি আবেদনের সময় ১৭০০ টাকা চার্জ রাখার প্রস্তাব করলেও বৈঠকে ২৭০০ টাকার কথা বলে।
ফি বাড়ানোর পরও চলছে সক্ষমতা যাচাই
সূত্র জানায়, ল্যাব এইডসহ আরও ৭-৮টি প্রতিষ্ঠান ২-৩ দিনের মধ্যে ল্যাব স্থাপন এবং ২২শ টাকা ফি নিয়ে পরীক্ষার কথা জানিয়ে আবেদন করলেও ডিএমএফআর আবেদনই মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটি দুই দফায় ভিন্ন তথ্য ও মূল্য বৃদ্ধি করলেও সেটি এড়িয়ে তাদের সক্ষমতা যাচাই করার প্রক্রিয়া চলছে।
ল্যাব বসানো সংক্রান্ত কমিটির একাধিক সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জরুরিভিত্তিতে দ্রুত ল্যাব স্থাপনে টেন্ডার ছাড়াই কাজ করা হবে। বেবিচক, স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা অনেকেই ডিএমএফআর মলিকুলার ল্যাব এন্ড ডায়াগনস্টিককে কাজ দিতে সুপারিশ করছেন। তবে কাজ শুরুর আগেই আবেদনে নানা অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে। এখন কাজ দেওয়ার পর তারা ঠিকমতো করতে না পারে, তবে কর্মীদের বিদেশযাত্রা আটকে যাবে। তখন দায়টা আমাদেরই নিতে হবে। যারা সুপারিশ করেছেন তারা নেবেন না।
এ বিষয়ে ফোন করলেও সাড়া দেননি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন। মোবাইলে মেসেজ পাঠালেও কোনও উত্তর দেননি তিনি।
ডিএমএফআর-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফাইজুর রহমান মরিশাসে অবস্থান করায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিষ্ঠানের আবেদন যাচাইয়ের জন্য পাঠিয়েছে। আমরা আমাদের মতামত জানিয়েছি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তারাই নেবে।
সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post