ওমানে নূন্যতম আয়ের সুযোগ থাকলে দেশে না ফেরার অনুরোধ জানিয়েছেন ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মাদ গোলাম সারওয়ার। শনিবার (৯ মে) ওমান প্রবাসীদের উদ্দেশে তিনি একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। বিদেশ থেকে এই মূহুর্তে লাখ লাখ লোক দেশে ফেরত গেলে নতুন করে জীবন জীবিকা শুরু করার ক্ষেত্রে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘আপাতত কষ্ট করে হলেও বিদেশে থাকার চেষ্টা করুন। কারণ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস পৃথিবীর সকল দেশের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে অন্য দেশের মতো ওমানও সহসাই ইনশাল্লাহ ঘুরে দাঁড়াবে।’
ওমানের অভিবাসী শ্রমিকের বড় অংশই বাংলাদেশি। সেখানে প্রায় আট লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীর মধ্যে লাখ দেড়েক নানা কারণে অবৈধ বা অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন। করোনায় সংক্রমিত হওয়ার চেয়ে বাংলাদেশের কর্মীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে তাড়িয়ে ফিরছে খাবারের সংকট আর কাজ হারানোর আশঙ্কা। এসব বাংলাদেশি অভিবাসীকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত।
বছর তিনেক আগে তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে কিছুটা আগ্রাসীভাবে এগোচ্ছিল ওমান। তেলের অব্যাহত দরপতনে ধাক্কা লাগে দেশটির অর্থনীতিতে। সবশেষে করোনার ছোবল দেশটিকে আরও পিছিয়ে দিয়েছে। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেশটি এখন পর্যন্ত ভালোই সামলাচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ ওমানের পতাকা ৩০১ না ২০১ রিয়াল?
তেলের দরপতন আর করোনায় পর্যুদস্ত ওমানে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশের কর্মীরা। কারণ মধ্যপ্রাচ্য সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) অন্যতম সদস্যদেশ ওমানের অভিবাসী শ্রমিকের বড় অংশই বাংলাদেশি। এর মধ্যে প্রায় দেড় লাখ কর্মী নানা কারণে অবৈধ বা অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন।
অভিবাসীদের বড় অংশ বাংলাদেশের। ওমানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা আর প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সব মিলিয়ে ওমানে অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় আট লাখ, ভারতের সাত লাখ, পাকিস্তানের আড়াই লাখ; বাকি আড়াই লাখের মধ্যে রয়েছেন মিসর, নেপাল, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার নাগরিক। বাংলাদেশের আট লাখ কর্মীর মধ্যে দেড় লাখের মতো বেশি অবৈধ।
আরও পড়ুনঃ বিষ পাঠান, বিষ খায়া আমরা একসঙ্গে মরে যাইগা-কুয়েত প্রবাসী
জানা গেছে, বাংলাদেশের অবৈধ বা অনিয়মিত হয়ে পড়া কর্মীদের বড় অংশই গেছেন ফ্রি ভিসার মাধ্যমে। অর্থাৎ, সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়োগকর্তার অধীনে কাজ করার জন্য তাঁরা ওমানে যাননি। ফ্রি ভিসায় শুধু ওমান নয়, মধ্যপ্রাচ্যের যেখানেই গেছেন, সেখানেই সংকটে পড়েছেন বাংলাদেশের কর্মীরা। ফ্রি ভিসার পাশাপাশি ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া, ওমানে অবস্থানের যথাযথ কাগজপত্র না থাকা ইত্যাদি নানা কারণে অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন বাংলাদেশের কর্মীরা।
ওমানের ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ওমানের শুক্রবারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিবাসীদের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেশি হওয়ায় সরকার তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিয়োগকর্তাদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছে। ফ্রি ভিসায় ওমানে অবস্থানরত অভিবাসীরা হাসপাতালে যাওয়ার প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে থাকছেন। কারণ, হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গেলেই তাঁদের অবৈধভাবে ওমানে উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ দ্বিতীয় দফায় ত্রাণ সহযোগিতা শুরু ওমান দূতাবাসের
এমতাবস্থায় ওমানে কোনো করোনা রোগীর বিষয়ে তথ্য লুকালে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ওমান সরকার এমন হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। ওমানের জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান জানানো হলো যে, সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের করোনা সংক্রমিত হলে বা লক্ষণ পাওয়া গেলে নিকটস্থ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান বা পরীক্ষা কেন্দ্রগুলিতে পাঠাতে হবে। বৃহত্তর জনস্বার্থে কোনো প্রতিষ্ঠান তথ্য গোপন করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিবে সরকার। করোনার লক্ষণ পাওয়া গেলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ওমানে বাংলাদেশের কর্মীদের বেশির ভাগই কোনো না কোনোভাবে নির্মাণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তা ছাড়া নির্মাণশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা পেশা এবং ওয়ার্কশপে কাজ করেন বাংলাদেশের নাগরিকেরা। করোনার কারণে মাস দুয়েক ধরে ছোটখাটো ওয়ার্কশপ, সেলুন ও লন্ড্রি বন্ধ। এগুলোতে মূলত বাংলাদেশের লোকজন কাজ করেন। খুব স্বাভাবিকভাবে কাজ বন্ধ থাকায় এরাও পড়েছেন খাবারের সংকটে। ফলে শুধু অবৈধ নয়, কাজ বন্ধ না থাকলে আয় নেই, খাবার নেই—এমন বাংলাদেশি কর্মীদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। আর অর্থনীতি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কেটে যাওয়া পর ঘুরে না দাঁড়ালে চাকরির ধাক্কা তো আছেই।
খাবারের সংকটে থাকা বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য দূতাবাসের কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শুক্রবার রাতে প্রবাস টাইমকে বলেন, “বাংলাদেশ দূতাবাস মাস্কাটের ২য় পর্বের ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে। প্রথম পর্বে ৩৫০০ জনের উপরে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। ২য় পর্বে ইনশাআল্লাহ সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার জনের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হবে।”
তবে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি অভিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের যে পরিমাণ লোকের খাবারের সংকট রয়েছে, সে তুলনায় দূতাবাসের সাহায্যের পরিমাণ মোটেও যথেষ্ট নয়। দূতাবাস এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ খাবার সরবরাহ করেছে এবং ভবিষ্যতে করবে, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লোক খাবারের সংকটে পড়েছেন। তাঁদের আরও অনেক বেশি সাহায্য–সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানান তাঁরা।
আরও পরুনঃ ওমানে করোনা রোগীর তথ্য লুকালেই আইনি ব্যবস্থা
বিষয়টি রাষ্ট্রদূত নিজেও স্বীকার করেছেন, ওমানে অবস্থিত আট লাখ বাংলাদেশির একটি বড় অংশ সমস্যায় আছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘শুধুমাত্র সরকারি সহযোগিতা এই বিপুল সংখ্যক ভাই-বোনদের কষ্ট লাঘবে যথেষ্ট হবে না।’ ওমানে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল বাংলাদেশিদের এই কঠিন দুর্যোগের সময়ে স্বদেশীদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আপনাদের আশে পাশে যারা সমস্যাগ্রস্ত আছেন তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। মানবতার কল্যাণে কাজ করার এখনই উপযুক্ত সময়।’
এই পরিস্থিতি আগামী তিন থেকে ছয় মাসে বাংলাদেশে কী পরিমাণ অভিবাসী ফিরে আসবেন, জানতে চাইলে গোলাম সারওয়ার বলেন, এখনই সংখ্যাটা আঁচ করা মুশকিল। সবটাই নির্ভর করবে অর্থনীতি কীভাবে আর কত তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অর্থনীতি চাঙা হতে সময় নিলে তা বাংলাদেশের অভিবাসীর জন্য দুঃসংবাদ নিয়ে আসবে। কত বাংলাদেশিকে দেশে ফিরতে হবে, তা এখন পর্যন্ত ওমান জানায়নি। তবে এখানকার বেশ কয়েকটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান জানিয়ে দিয়েছে, তারা বাংলাদেশের কর্মীদের চুক্তি আর নবায়ন করছে না। তাঁদের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওমান থেকে আগামী কিছুদিনের মধ্যে অন্তত দেড় হাজার অভিবাসীকে দেশে ফিরতে হবে। সব মিলিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর ওমানে বাংলাদেশের অভিবাসীদের জীবনকে চরম অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তেলের দাম আবার বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের কর্মীদের কাজ হারানোর শঙ্কাটা কেটে যাবে। এরপরও বাংলাদেশের কর্মীদের একটা অংশকে—বিশেষ করে অবৈধ হয়ে পড়া লোকজনের জন্য ভবিষ্যৎটা ভালো নয়। একসঙ্গে না হলেও তাঁদের বড় অংশকে আগে বা পরে চলে আসতে হবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
রবিবারের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে মোট করোনা সংক্রমিত হয়েছে ৩,৩৯৯জন। যাদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১,১১৭ জন এবং মারা গেছেন ১৭ জন। মাস্কাটে মোট আক্রান্ত ২৪৭৬ জন, এরমধ্যে মাতরাহ অঞ্চলেই ১,৭২৭ জন আক্রান্ত। এর পরেই রয়েছে উলাইয়াত আল সিব অঞ্চল। সিবে আক্রান্ত ৩৬১ জন। দেশটিতে করোনা রোগী মৃত্যুর ১৫ শতাংশ মাস্কাটের নাগরিক। মারা যাওয়া ও সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই বিদেশি বলে বলা হচ্ছে। তবে কোন দেশের নাগরিক কতজন, তা দেশটি জানাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে সংক্রমিত আর মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশি মানুষের সংখ্যা কত, তা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও জানতে পারিনি। দেশটি এ নিয়ে কোনো তথ্য জানাতে তাদের অপারগতার কথা জানিয়েছে। তবে ওমান নিজের নাগরিকের পাশাপাশি বিদেশি নাগরিকদের চিকিৎসার সব ভার নিজেদের কাঁধে নিয়েছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আশ্বস্ত হওয়ার ব্যাপারও রয়েছে।’
https://www.youtube.com/watch?v=_C6JICciFPM
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post