বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের বিজয়ে মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। ছাত্রদের এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সব শ্রেণি-পেশার সাধারণ মানুষ রাজপথে শরীক হয়েছিলেন। আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। স্বাধীন বাংলাদেশের এই বিজয়কে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে আন্দোলনকারীরা আখ্যায়িত করেন। উনিশ শ একাত্তরে ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন এই দেশে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে বসবাসকারী প্রায় ১৬ কোটি মানুষের একটি পরিচয়-“আমার বাঙালি”। দেশে সব মানুষের রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা পাওয়া ও মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। একটু পিছনে ফিরে স্মরণ করি, নব্বই এর ছাত্র আন্দোলনের দাবির কথা। সে সময়ে কী ঘটেছিলে প্রিয় মাতৃভূমি এই বাংলাদেশে। কত মানুষ রক্ত দিয়েছিলেন অধিকার আদায়ে। যাঁদের আত্মত্যাগে সফল হয়েছিল আন্দোলন। সেই আন্দোলনের সুফল আমরা কতটুকু পেয়েছি বা পাচ্ছি?
নব্বই এর সামরিক শাসক এরশাদ পতন আন্দোলনে মানুষের প্রত্যাশা ছিল গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বাক স্বাধীনতা, ভোটাধিকার, শিক্ষা, কৃষি-শিল্প, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, ঘুষ-দুর্নীতি রোধ ইত্যাদি। সে সময় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ১০ দফা ব্যাপক সমর্থন পায় ও গণদাবিতে পরিণত হয়। ছাত্র আন্দোলনে দাবি ওঠে জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্রদের অধিকারের বিষয়টি যুক্ত করা। সে প্রত্যাশাকে ধারণ করেই সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের পক্ষ থেকে ১০ দফা ঘোষণা করা হয়। তখন ছাত্র ঐক্য থেকে বলা হয়েছিল, যারাই ক্ষমতায় আসবে তাদেরকে এই দাবি কার্যকর করতে হবে। বিস্ময় করা বিষয়, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের অন্যতম দুই শরীক সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের অভিভাবক দল একাধিকবার ক্ষমতায় গেলেও ছাত্রসমাজের রক্তে ভেজা সেই দাবি বাস্তবায়িত হয়নি, গুরুত্বও পায়নি।
২০২৪ সালের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে জুলাই থেকে চার দফা দাবিতে আন্দোলনকারী ছাত্ররা লাগাতার কর্মসূচি দেয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। ৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রীরা ‘বাংলা ব্লকেড’-এর ডাক দেয়, যার আওতায় ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ৩ আগস্ট শহিদ মিনার থেকে সরকার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলন ঘোষণা করেন। এ আন্দোলনকে ঘিরে অনেক জেলায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, এতে ৪ শ’র অধিক ছাত্রছাত্রী, সাধারণ মানুষ ও পুলিশ নিহত হয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ১ দফা দাবির প্রেক্ষিতে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন। ছাত্রদের আন্দোলনের বিজয় হয়। দেশের সাধারণ মানুষ তারুণ্যের এই বিজয়ে প্রশংসা করে তাদের স্যালুট জানান।
সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ বছর আন্দোলন, সংগ্রামের পর তার পতন হয়েছিল। সে আন্দোলনে তিন শ এর অধিক মানুষ জীবন দিয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও চার শ এর অধিক মানুষ জীবন দিয়েছেন, পঙ্গু ও গুম হয়েছেন হাজারো মানুষ।
অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য, শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের কারণ। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বাক স্বাধীনতা, ভোটাধিকার, কর্মসংস্থান, ঘুষ-দুর্নীতি রোধ ইত্যাদি অর্জনের উদ্দেশ্য ছিল নব্বইয়ের ছাত্র আন্দোলন। দেশ স্বাধীনের তেপ্পান্ন বছরে কয়েকবার ক্ষমতার পালাবদল হলেও আমরা কি বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি?
নব্বই এর গণআন্দোলনের অনেক ছাত্রনেতা পরবর্তীতে জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছেন, মন্ত্রীও হয়েছেন। সে পরিচয়-গৌরব কাজে লাগিয়ে পদ-পদবি অর্জন করেছেন, অর্থ-বিত্তের মালিকও হয়েছেন। কিন্তু সেই চেতনার কথা কেউ মনে রাখেননি। অথচ তাদের সবাই নিজেদের সে অভ্যুত্থানের মহান নেতা হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব করেন। যেসব তরুণ-যুবক জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করেছেন, নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের জীবন, পরিবার, বিপর্যয়ের কথা কে মনে রাখে? কে রাখে পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্র জেহাদ আর তাঁর রক্তেরঞ্জিত ১০ দফার খবর? নব্বই এর চেতনার শপথ নষ্ট রাজনীতির অন্ধকার গলিতে আজ হারিয়ে গেছে।
মনে শঙ্কা জাগে, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে আবারও কি হারিয়ে যাবে নব্বইয়ের আন্দোলনে নিহত ছাত্র জেহাদের মতো এবারের বৈষম্যহীন ছাত্র আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদ, মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ, ওয়াসিম, ফয়সল আহমেদ, নাঈমা সুলতানাদের আত্মত্যাগ।
স্বাধীনতার পর থেকে দেশের জনগণ একদলীয় সরকার, সামরিক স্বৈরাচার, নির্বাচিত স্বৈরশাসন দেখেছে। জনগণের প্রত্যাশা, নব্বইয়ের ছাত্রআন্দোলনের নেতাদের মতো বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরুণ নেতারা শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার পালাবদলে না থেকে বৈষম্যহীন সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে বড় ভূমিকা রাখবেন। দেশের মানুষের আরও প্রত্যাশা চির সবুজ এই তরুণাই যেন দেশের প্রতিটি সেক্টরে সংস্কার করে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার নেতৃত্ব দিবে। তরুণদের এই নেতৃত্বকে অনুসরণ করে পরবর্তী প্রজন্মের তরুণরা দেশকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের ধারা চলমান রাখবে এবং বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে একসময় রোল মডেল হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।

Discussion about this post