উপমহাদেশে আমার পদচারণা সেই আদিকাল থেকেই। একসময় সবাই ঘুমিয়ে গেলে বর্গি নামক চোর হানা দিত এই অঞ্চলে। তাই তো তখন ঘুমপাড়ানি গানে বলা হতো, ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে…’। বর্গির পর আমার ব্রিটিশ ভাই বেরাদাররা তথা ব্রিটিশ চোরের দল ১৯০ বছর ধরে এ দেশের মণিমাণিক্য এমনকি তাদের রাজমুকুটে লাগানোর হীরা-জহরতও চুরি করে নিয়ে যায়।
ই অক্ষরের ছোট্ট একখানা নাম আছে আমার—চোর। বানান ও জাত বিবেচনায় আমি ছোট হতে পারি, কিন্তু কাজের বেলা আমি বুঝিয়ে দিই এই জগতে ‘চোর যার, মুল্লুক তার’। স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাচাও গতবার ভোট হেরে বলেছিলেন রাশিয়ান চোররা চুরি করে তাকে হারিয়ে দিয়েছে। এই যে অতিসম্প্রতি তোমরা ৪০০ পাতার একটা শ্বেতপত্র বের করেছ, তার পরতে পরতে আমার উপাখ্যান লেখা। প্রিয় বাবুদের কাছে আমি যতই অপ্রিয় হই, আমার নাম না নিয়ে তিনি কিন্তু থাকতে পারেন নাই। রাজনীতিবিদ, আমলা আর ব্যবসায়ীদের বখে যাওয়া অংশটি বিগত বছরগুলোতে যা করেছে এবং অর্থনীতির যে হাল করেছে, প্রিয় বাবুরা তার নাম দিয়েছেন ‘চোরতন্ত্র’। এবার আমাকে পায় কে? গণতন্ত্র, ধনতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদি নানা জাতের তন্ত্র-মন্ত্রের সঙ্গে একই রেড কার্পেটে এবার বীরদর্পে হাঁটবে চোরতন্ত্র। কারণ একটাই। ‘ক্ষমতা যার যার, চোর সবার’। তবে এমন খুশির সঙ্গে আমার দুঃখবোধও আছে। কবিগুরু রবিবাবু ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতায় লিখেছিলেন—‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর’। আর শ্বেতপত্র পাঠ শেষে দেব বাবু কৃষ্ণ বদনে বললেন ‘চোরতন্ত্র’ কায়েম হয়েছে! আমি নিরস্ত্র, ছোট আর নিচু জাতের বলেই কি আমাকে কেষ্ট বানিয়ে সবকিছু আমার ওপর দিয়ে চালিয়ে দিলেন দেবুদা? কেন রে দাদা? আমার বড় ভাইদের কায়েম করা ডাকাততন্ত্র, গুমতন্ত্র, ছিনতাইতন্ত্র, গায়েবতন্ত্র, লুটেরাতন্ত্র, সিস্টেম লসতন্ত্র, হাইজ্যাকতন্ত্র, বালিশতন্ত্র, পৰ্দাতন্ত্র, রডের বদলে বাঁশতন্ত্র—এমন কতশত তন্ত্র-মন্ত্রের কথা কিছুই তো বললেন না। এজন্যই বোধহয় লিচু চোর কবিতার জনক কবি নজরুল ইসলাম তার কুলি কবিতায় প্রশ্ন তুলেছেন—‘এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল’?
পৃথিবীর আদিমতম পেশার একটি চুরি। এই উপমহাদেশে আমার পূর্বপুরুষরা বহু আগে গরু চোর, সিঁদেল চোর, ছিঁচকে চোর—এমন জঘন্য নামে অপমানিত হয়েছেন, সম্মান হারিয়েছেন। তাই নিজের বংশ পরিচয় দিতে একটু সংকোচ করতাম। কিন্তু যেদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে এক সকালে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার নাই হয়ে গেল, তখন তোমরা খবরের শিরোনাম করলে—‘বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি’। সেদিন থেকেই আমি যাতে উঠে গেলাম। আবিষ্কার করলাম আমাদের পূর্বপুরুষের মতো গভীর রাতে খালি গায়ে তেল লাগিয়ে গৃহস্থের সিঁদ কেটে তালা ভেঙে সিন্দুক খুলে চুরির দিন শেষ। এখন আমি ডিজিটাল চোর। আমি ‘খুলে যা সিম সিম’ পাসওয়ার্ড দিলেই খুলে যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রত্নভান্ডার তথা রিজার্ভ। শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন আর আমেরিকার ভাই বেরাদারদের নিয়ে ‘নগদ যা পাও-হাত পেতে নাও’ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তখন থেকেই আমি কাজে নেমে পড়ি। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা, ব্রিটেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই এবং অতিসাম্প্রতিক সময়ে পানামা আর সিমান আইল্যান্ডের মতো অফশোর দেশসমূহের চোরদের সঙ্গে আমি একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছি। পৃথিবীর সব চোর এখন এক নেটওয়ার্কের আওতায়। তোমরা যখন ইন্টারপোল নিয়ে মাঠে নেমেছ, আমরা তো তখন আর একা একা খেলতে পারি না। বসেও থাকতে পারি না। তাই আমরাও ঐক্যবদ্ধ। এবার আসো, ‘খেলা হবে, খেলা হবে… বে…বে…’। দেখি এবার, চোরের মার বড় গলা, না পুলিশের শাশুড়ির বড় গলা? খেলা হবে? ‘মা বড় না শাশুড়ি বড়’, ‘চোর বড় না পুলিশ বড়’—এরকম নামে অচিরেই সিনেমা দেখাব তোমাদের। কেন সিনেমার গান শোনোনি ‘সুন্দরী চোর মনের ফাঁদে ঢুকেছে, পুলিশ চোরের প্রেমে পড়েছে, ও দারোগা, পুলিশ চোরের প্রেমে পড়েছে’।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন আর দেশ ভাগের সময় বড় দাঙ্গা হয় দেশের বিশেষ একটি অঞ্চলে। তখন শান্তি প্রতিষ্ঠায় সেই অঞ্চলে ছুটে আসেন মহাত্মা গান্ধী। বেচারা নিয়মিত ছাগির দুধ খেতেন বিধায় দুটো ছাগি সঙ্গে করে এনেছিলেন। সেই দুটি ছাগির একটি আমার এক ভাই নাই করে দেয়। তবে তার ছিল মহান হৃদয়। জবাই করা সেই ছাগির গোস্ত মহান চোর ভাই খাইয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর মেহমানদের। ছাগল শব্দযুক্ত একটি এলাকার মানুষকে এই নিয়ে আজও খোটা শুনতে হয়। অথচ দোষ কিন্তু ছাগলের নয়, আমার।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা ২৪ বছর শাসনের নামে পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছুই চুরি করেছেন। আমাদের পাট আর চা রপ্তানির টাকায় তাদের শহর, নগর, বন্দর গড়ে উঠত। মুক্তিযুদ্ধের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ প্রায় সব ব্যাংকের টাকা আর ব্যাংক ও জুয়েলারিতে থাকা সোনাদানা সব চুরি করে আমার পাকিস্তানি ভাইয়েরা। স্বাধীনতার পর নিজ দেশে আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। তখন চোরের বিষয়ে এক নেতা দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘এত চোরের চোর, এত চোর কোত্থেকে যে পয়দা হয়েছে আমি জানি না, পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে কিন্তু এই চোরটুক দিয়ে গেছে আমারে। এই চোর টুক নিয়ে গেলে আমি বাঁচতাম’। এক ভাষণে এই নেতা আরও বলেছিলেন, ‘চোর নাহি শুনে ধর্মের কাহিনি। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আমাকে আনতে হয় আর এই চোরের দল আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে। এভাবে লুটতরাজ করে খায়। …দেখি কতদিন তারা টিকতে পারে। চোরের শক্তি বেশি, নাকি ইমানদারের শক্তি বেশি—সেইটা আজ প্রমাণ হয়ে যাবে।’ তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ তখন বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের জন্য ত্রাণ হিসেবে আট কোটি কম্বল এসেছিল। কিন্তু যে নেতা এই কম্বল আনলেন, তিনি নিজেই কম্বল পেলেন না। সর্বস্তরে তখন থেকেই প্রতীকী প্রশ্ন ছিল—‘আমার কম্বল গেল কই?’
সেই তখনকার দিনে কম্বল চুরি থেকে শুরু করে আজ বাংলাদেশের বহু ব্যাংকের শেষ সম্বল চুরি, কোথাও আমার নেইকো জুরি। গানের সুর ও বাণী চুরি, উপন্যাসের ঘটনা চুরি, সিনেমার কাহিনি চুরি, নাটকের প্লট চুরি, সাজসজ্জার ডিজাইন চুরি, গোল্ড মেডেলের স্বর্ণ চুরি—এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। দেখে না কেউ চোখটি নাড়ি। সবাইকে যে ম্যানেজ করি, দেখবে তবে কেমন করি। কী হবে আর লজ্জা করি, একটা কথা ফাঁস করি। পিএইচডি আর বই রচনায় শিক্ষিতরাও করে চুরি। শিক্ষিতদের চুরি দেখে লালন কি কয় চলুন পড়ি :
“চোর দিয়ে চোর ধরা ধরি একি কারখানা
আমি তাই জিজ্ঞাসিলে তুমি বলো না
সাধুরা চুরি করে চোরেরা পালায় ডরে
সে চোর ধরে রাখি আমি কেমনে… কেমনে…”
এখানে লক্ষণীয় যে, লালন কিন্তু শিক্ষিত ছিলেন না। ধনসম্পদ বলতে তার কিছুই ছিল না। অভাবে স্বভাব নষ্ট—কথাটা তার বেলায় খাটে না। তাই তিনি পালাননি। চোরেরা ডরে পালায়, সাধুরা ভাসে সুখের ভেলায়, কার সাধ্য এমন কথা চোরদের মাথায় ঢুকায়?
সেই যুগের লালন আর এ যুগের নচিকেতা যেন একই ভাবগুরুর শিষ্য। চোর নিয়ে নচিকেতারও একটা দারুণ গান আছে:
‘ভিড় করে ইমারত আকাশটা ঢেকে দিয়ে
চুরি করে নিয়ে যায় বিকেলের সব রোদ
ছোট ছোট শিশুদের শৈশব চুরি করে
গ্রন্থকীটের দল বানায় নির্বোধ
এরপর চুরি গেলে বাবুদের ব্রিফকেস
অথবা গৃহিণীদের সোনার নেকলেস
সকলে সমস্বরে একরাশ ঘৃণা ভরে
চিৎকার করে বলে চোর… চোর… চোর… চোর’।
রসিকজনরাও কম যায় না। আমাকে নিয়ে বানানো গাঁজাখুরি গল্পেরও তাই শেষ নেই। মোটা মাথার পাঠানদের নিয়ে তেমনি দুটি গল্পে আমি ছিলাম মূল চরিত্র। একবার এক পাঠান থানায় এসে ডিউটি অফিসারকে বলল, স্যার, আমার বাসায় চোর এসেছে আপনি চলেন। অফিসার জিজ্ঞেস করল, চোর এখন কোথায়? পাঠান উত্তর দিল, আমার বাসায় বেঁধে রেখেছি। অফিসার আবার জিজ্ঞেস করল, কীভাবে বেঁধেছ? পাঠানের উত্তর, একটি রশির একপ্রান্ত চোরের এক পায়ে বেঁধে সেই রশির আরেক প্রান্ত গাছের সঙ্গে বেঁধে এসেছি। অফিসার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা তুমি কী করেছ? চোরের তো দুহাতই খোলা। চোর তো নিশ্চয়ই খোলা হাত দিয়ে পায়ের রশি খুলে এতক্ষণে পালিয়ে গেছে। অনেক ভেবে পাঠান বলল, স্যার, চোরও জাতে পাঠান। আমার মাথায় যখন এই বিষয়টি আসেনি, নিশ্চয়ই এটা চোরের মাথায়ও আসবে না। এরপর অফিসার পাঠানকে নিয়ে দ্রুত তার বাড়িতে গেলেন এবং দেখলেন সত্যি সত্যি এক পায়ে রশিবাঁধা চোর দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে।
আরেকবার এক পাঠান পুলিশ সারা দিন ডিউটি করে ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে ছিল। গভীর রাতে তার বাড়িতে চোর ঢুকে। টের পেয়ে পাঠানের বউ পাঠানকে ধাক্কা দিতে থাকে এবং বলে—ওঠো ওঠো, ঘরে চোর ঢুকেছে! পাঠান রেগে উত্তর দিল, আমার ডিউটি টাইম শেষ। এখন আমি কিছুতেই চোর ধরতে পারব না। তবে আলগা টাকা দিলে ভেবে দেখতে পারি।
তাই বলে এ দেশের পুলিশ কিন্তু এত বোকা নয়। বউয়ের প্রতি উদাসও নয়। তারা বউ-ভক্ত এবং অনেক চালাক। চালাক বলেই বিদেশে বড় বড় ভবনে লাগানো কিছু বিপথগামী পুলিশ ও তাদের বউদের নামফলক। শুধু চোরদের সামনে পড়লেই তাদের খোলে না না চোখের পলক। কারণ চোরের আছে টাকার ঝলক।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।

Discussion about this post