সম্প্রতি দেশ ছেড়েছেন হামলার শিকার হওয়া সাংবাদিক রিয়াজ সোহেল। উড়োজাহাজে বসা একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে তিনি লিখেন- ‘আবার আসিবো ফিরে, জয় বাংলার নীড়ে’।
জানা যায়, ২৫ অক্টোবর শুক্রবার রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের পাশে ২০-২৫ জনের একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ রিয়াজ সোহেলের পথরোধ করে। এসময় তার মোবাইল ফোন চেক করার চেষ্টা করে সংঘবদ্ধ গ্রুপটি। রিয়াজ তার ফোন দেখাতে অস্বীকৃতি জানালে মারধরের শিকার হন। হামলাকারীরা তাকে দুই ভবনের মাঝের সরু পথে নিয়ে ফের মারধর করে।
মারধরের একপর্যায়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এসে রিয়াজ সোহেলকে দ্রুত থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য সংঘবদ্ধ গ্রুপটির উপর চাপ প্রয়োগ করে। এরপর টেনে হিঁচড়ে তাকে নিউমার্কেট থানায় নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ চক্রটি। থানায় নিয়ে ফের মারার চেষ্টা করলে পুলিশের বিচক্ষণতায় শেষ রক্ষা পান তিনি।
নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে জানান- ‘রিয়াজ সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। কারণ তার মোবাইল চেক করতে চেয়েছিল একটি দলের নেতাকর্মীরা। রিয়াজ দেয়নি বলে তাকে পেটানো হয়েছে’।
রিয়াজ সোহেল ২০১৩ সাল থেকে ‘দৈনিক সাহস’ নামক একটি পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া দৈনিক পর্যবেক্ষণেরও রিপোর্টার ছিলেন। সর্বশেষ জাগতিক নিউজ এ কর্মরত ছিলেন তিনি। এই পত্রিকার অফিসের সামনেই মূলত হামলার ঘটনা ঘটে।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি রিয়াজ সোহেল গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন-প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়া, ধর্মভিত্তিক শিক্ষার বিপরীতে বিজ্ঞান ও ক্রীড়া নির্ভর শিক্ষার প্রসারে কাজ করেছেন তিনি। ‘তুখোড়’ নামে একটি শিশু সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক তিনি। পথশিশু স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করতো সংগঠনটি। এছাড়া দুর্গম পাহাড়ে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি।
ঘটনার দিন সাংবাদিক রিয়াজ সোহেলের উপর হামলা ও গ্রেফতারের খবর ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদ জানান গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মী এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। ‘বেঙ্গল নিউজ ২৪’ এর সম্পাদক তৈমুর তুষার ফেসবুকে লিখেন- ‘রিয়াজ মারাত্মক আহত। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা জরুরি। কোনো মামলা না থাকার পরও একজন মারাত্মক আহত ব্যক্তিকে আটকে রেখেছে পুলিশ’।
দেশ ত্যাগের পর রিয়াজ সোহেল জানান- ২০ থেকে ৩০ জনের সংঘবদ্ধ গ্রুপ থানা ঘিরে রেখেছিলো। এমন পরিস্থিতিতে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হতে পারতো। সে কারণেই হয়তো পুলিশ হসপিটালে নেয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। এছাড়া গভীর রাত পর্যন্ত ওসিকে ঘিরে রেখে হত্যা মামলায় তাকে আসামি করার জন্য চাপ দিতে থাকে চক্রটি। রাতভর রিয়াজ সোহেলের মোবাইল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একাউন্টগুলো যাচাই বাছাই করা হয়। হত্যা মামলায় আসামি করার হুমকি দিয়ে রিয়াজের পরিবারের সদস্যদের থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করে চক্রটি। পরদিন একটি সন্দেহভাজন মামলায় রিয়াজ সোহেলকে আদালতে প্রেরণ করা হয়। আইনি প্রক্রিয়া শেষে আদালত থেকে মুক্ত হন তিনি।
রিয়াজ সোহলে বলেন- প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলনে সম্পৃক্ততা এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে যায় এমন সংবাদ প্রকাশ করায় দেশের স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠী এই হামলা করেছে। হামলাকারীরা আমার প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের কথা উল্ল্যেখ করে গালাগাল ও মারধর করতে থাকে। দুইজন স্থানীয় উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর সদস্য ছাড়াও হামলাকারীদের মধ্যে এক বা একাধিক মৌলবাদী গোষ্ঠীর সদস্য ছিলো।
এদিকে রিয়াজ সোহেলের দেশ ত্যাগের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।
মানবাধিকার কর্মী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা অপরাজিতা সংগীতা বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে বৈষম্যহীনতা, বাকস্বাধীনতা, সমতা, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা হবার কথা ছিলো তার পরিবর্তে আমরা দেখছি দেশে মৌলবাদের রাজত্ব কায়েম হয়েছে।
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী সাকিল আহমদ (অরণ্য) বলেন, গত ১ দশকের বেশী সময় ধরে রিয়াজ সোহেলের জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানই তাঁর আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ বলে মনে করি। বিগত বছরগুলোতে জঙ্গীরা বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল লেখক ও এক্টিভিস্টকে হত্যা করেছে। গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশীরভাগ জঙ্গীরা জেল থেকে বের হয়েছে এবং প্রগতিশীল অনেক মানুষকে আক্রান্ত করছে।
মানবাধিকার কর্মী ও সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী জীবনানন্দ জয়ন্ত বলেন- এই ধরণের ঘটনা জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থি। যা মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার সমর্থন করে না। পুলিশ যে আইনে তাকে গ্রেফতার কর আদালতে প্রেরণ করছে তা আইনের অপপ্রয়োগ। কারণ এ ধরণের ঘটনায় কখনোই ডিএমপি অ্যাক্ট- ৮৬ ধারার উপাদানকে সমর্থন করে না। বরং এই ধরণের আক্রমনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ পুলিশের ছিলো। কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে নিজেদের দেওলিয়াত্ব ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে, যা কাম্য নয়।
‘বেঙ্গল নিউজ ২৪’ এর সম্পাদক তৈমুর তুষার বলেন- গত আগস্ট থেকে দেশে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মানুষের ন্যুনতম কোনো নিরাপত্তা দিতে পারছে না রাষ্ট্র। এদেশে জনগণ কখনো এমন অনিরাপদ ছিল না। ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ একেবারেই কমে এসেছে। ভিন্নমতের মানুষদের রাষ্ট্রীয় মদদে আক্রমণ করা হচ্ছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সরাসরি নির্দেশে ভিন্নমতের মানুষদের উপরে হামলা চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় রিয়াজের উপরে হামলা হয়েছিল। এখন নিরাপত্তাহীনতার কারণে রিয়াজের মতো উদীয়মান তরুণরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। এটি জাতির জন্য লজ্জাজনক।
কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট পতন ঘটে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পর সারাদেশে সহিংসতা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সহিংসতায় বহু মানুষ প্রাণ হারান। দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মাঝে দেশ ত্যাগ করেছেন রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে দেশ ত্যাগের হার আরো ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post