বিশ্ব মুসলমানদের তিন পবিত্র নগরীর একটি ফিলিস্তিনের বায়তুল মাকদিস। একই সঙ্গে ইব্রাহিম (আ.) থেকে উৎসারিত আরও দুই ধর্মেরও তীর্থভূমি বায়তুল মাকদিস। পবিত্র এ মসজিদ ঘিরে গড়ে উঠেছে জেরুজালেম নগরী। অসংখ্য নবী-রাসুলের স্মৃতিমুখর এ ভূমি। শবেমেরাজের সময় আমাদের নবীজিও এ মসজিদ সফর করেন এবং এখান থেকেই শুরু হয় তার ঊর্ধ্বজগৎ পরিভ্রমণ। পবিত্র কোরআনে এ ভূমির ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি নিজ বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ১)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং আমি তাকে ও লুতকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম সেই দেশে, যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি বিশ্ববাসীর জন্য।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৭১)। ফলে প্রত্যেক মুসলমানের অন্তরে ফিলিস্তিন ভূমির ভালোবাসা প্রোথিত। তারা পবিত্র এ ভূমির মুক্তি কামনা করে। তারা চায় এখানে সব ধরনের হানাহানি বন্ধ হোক এবং ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রকৃত উত্তরসূরিরা নিরাপদে জীবনযাপন করুক। ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনি মুসলমানদের মুক্তিপ্রত্যাশী মানুষদের জন্য রয়েছে মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুসংবাদ, যা থেকে প্রমাণিত হয় পবিত্র এ ভূমি অবশ্যই ভিনদেশি অভিশপ্তদের দখলদারি ও অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভ করবে।
কেয়ামতের আগে পৃথিবীতে আবারও ইসলামী খেলাফত বা নববি শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। আর সেই শাসনের সূচনা হবে ফিলিস্তিন থেকে। আবদুল্লাহ ইবনে হাওয়ালা আল আজদি (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার মাথা বা মাথার তালুতে হাত রেখে বললেন, হে ইবনে হাওয়ালা! যখন তুমি দেখবে যে বায়তুল মাকদিসে (বা শাম দেশে) খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন মনে করবে অধিক ভূমিকম্প, বিপদ-আপদ, মহাদুর্ঘটনা ও পেরেশানি সন্নিকটে। কেয়ামত তখন মানুষের এতই নিকটবর্তী হবে, যেমন আমার এ হাত তোমার মাথার যত নিকটে আছে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস: ২৫৩৫)। কেয়ামতের আগে ফিলিস্তিন ভূমি থেকে অবশ্যই অবৈধ দখলদারির অবসান এবং মুসলমানের বিজয় আসবে। যদিও সে বিজয় হবে কেয়ামতের নিদর্শনস্বরূপ। মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বায়তুল মাকদিসে বসতি স্থাপন ইয়াসরিবের বিপর্যয়ের কারণ হবে। আর ইয়াসরিবের বিপর্যয় সংঘাতের কারণ হবে। যুদ্ধের ফলে কুসতুনতিনিয়া বিজয় হবে এবং কুসতুনতিনিয়ার বিজয় দাজ্জালের আবির্ভাবের আলামত।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস: ৪২৯৪)
হাদিসের বর্ণনা ও ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যা অনুসারে ইসা (আ.) দাজ্জাল ও তার অনুসারী ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। তাদের যুদ্ধ হবে ফিলিস্তিন ভূমিতে। ইসা (আ.) ফিলিস্তিনের লুদ শহরে দাজ্জালকে হত্যা করবেন। অতঃপর যুদ্ধে ইহুদিদের পরাজিত করবেন। তারা পালিয়েও আত্মরক্ষা করতে পারবে না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৯২২; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১/১২৮)। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, কেয়ামতের আগে ফিলিস্তিন ভূমি থেকেই মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়া হবে। দাজ্জালের জগদ্ব্যাপী ফিতনা থেকে মহান আল্লাহ দুটি শহর ও চারটি মসজিদকে রক্ষা করবেন। শহর দুটি হলো মক্কা ও মদিনা এবং মসজিদ চারটি হলো মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববি, মসজিদে তুর ও মসজিদে আকসা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মক্কা ও মদিনা ছাড়া এমন কোনো শহর নেই যেখানে দাজ্জাল পদাচরণ করবে না। মক্কা ও মদিনার প্রতিটি প্রবেশপথেই ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে পাহারায় নিয়োজিত থাকবেন। এরপর মদিনা তার অধিবাসীদের নিয়ে তিনবার কেঁপে উঠবে এবং আল্লাহতায়ালা সব কাফির ও মুনাফিকদের বের করে দেবেন। (সহিহ বোখারি, হাদিস: ১৮৮১)। অন্যদিকে দাজ্জাল ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে পারলেও মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করতে পারবে না। নবীজি (সা.) বলেন, দাজ্জাল চারটি মসজিদের কাছে যেতে পারবে না। তা হলো মসজিদুল হারাম, মসজিদে মদিনা (নববি), মসজিদে তুর ও মসজিদে আকসা। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৩৬৮৫)
ইমাম মাহদি শেষ মুহূর্তে মুসলিমদের নিয়ে মসজিদুল আকসায় আশ্রয় নেবেন। বাইরে দাজ্জাল ইহুদিদের নিয়ে তাদের হত্যা করার জন্য বন্দি করে রাখবে। অন্যদিকে মুসলিমরাও দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবে। এরই মধ্যে ইসা (আ.) দামেস্কে আগমন করবেন এবং তিনি মুমিনদের রক্ষা করতে ফিলিস্তিনে রওনা হবেন। তিনি মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করে মুসলমানদের নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যার জন্য বের হবেন। দাজ্জাল পশ্চিম দিকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ফিলিস্তিনের লুদ নামক স্থানে তিনি তাকে হত্যা করবেন। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২২৪০)।
দাজ্জাল সম্পর্কিত সুনানে তিরমিজির দীর্ঘ বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায়, ফিলিস্তিন হবে ইসা (আ.)-এর বিচরণ ভূমি। এমনকি দাজ্জাল হত্যার পর ইয়াজুজ-মাজুজের আবির্ভাব হলে তারা ফিলিস্তিনের ‘আল খামার’ পাহাড়ে এসে তাদের আগ্রাসন শেষ করবে। ইসা (আ.) তখন মুমিনদের নিয়ে তুর পাহাড়ে চলে যাবেন (বর্তমান ইসরায়েলের একটি পাহাড়ের নাম তুর, তবে বিখ্যাত তুর পাহাড় মিশরে অবস্থিত)। এর দ্বারা বোঝা যায়, ইয়াজুজ-মাজুজ বাহিনীকে আল্লাহ ফিলিস্তিনে ধ্বংস করবেন এবং ফিলিস্তিন ভূমি অন্য ভূমির তুলনায় বেশি সময় নিরাপদ থাকবে। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২২৪০)। বায়তুল মুকাদ্দাস তথা ফিলিস্তিনকে মহানবী (সা.) বিজয়ীদের ভূমি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমার উম্মতের একটি দল সত্যের ওপর বিজয়ী থাকবে। শত্রুর মনে পরাক্রমশালী থাকবে। দুর্ভিক্ষ ছাড়া কোনো বিরোধীপক্ষ তাদের কিছুই করতে পারবে না। আল্লাহর আদেশ তথা কেয়ামত পর্যন্ত তারা এমনই থাকবে। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! তারা কোথায় থাকবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তারা বায়তুল মুকাদ্দাস এবং তার আশপাশে থাকবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২২৩২০)।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post