স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব পদের কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়ি দাপ্তরিক ও ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। যে দপ্তর থেকে গাড়ি নিতেন, সেই দপ্তর থেকেই দিতে হতো জ্বালানি ও মেরামতের সব ব্যয়। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ১০ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৯ টাকা। এসব সুবিধা দিতে বিলম্ব হলে সচিবদের তোপের মুখে পড়তে হতো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। এ ধরনের অবৈধ সুবিধা দেওয়ার কারণে এবার শাস্তির মুখে পড়তে যাচ্ছেন অধিদপ্তরের পাঁচজন লাইন ডিরেক্টর।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অডিট ইউনিটের ৬ অক্টোবরের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘চতুর্থ স্বাস্থ্য জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচির ২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাব সম্পর্কিত সিএজির কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তর থেকে পাওয়া গেছে।
আপত্তিকৃত টাকা আদায় করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে লাইন ডিরেক্টরদের নির্দেশ দিয়ে অডিট অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, অপারেশন প্ল্যানের সব যানবাহন কেনা হয়েছে প্রকল্পের কাজে ব্যবহারের জন্য। এ ক্ষেত্রে যানবাহনগুলো প্রকল্প কাজে ব্যবহার না হলেও জ্বালানি ও মেরামত কাজে প্রকল্প থেকে ব্যয় রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বিধি অনুসারে একজন দূরদর্শী ব্যক্তি নিজের টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করেন, সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সে ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে তা প্রতিপালন হয়নি, যা গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচির আওতায় লাইন ডিরেক্টর হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট (এইচএসএম), ম্যাটারনাল নিওনেটাল চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ (এমএনসিঅ্যান্ডএইচ), লাইফস্টাইল অ্যান্ড হেলথ এডুকেশন অ্যান্ড প্রোমোশন, নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (এনসিডিসি), ন্যাশনাল নিউট্রিশন সার্ভিসেসের (এনএনএস) ২০১৯-২০ অর্থবছরে এইচপিএনএসপি কর্মসূচির আওতাবহির্ভূত কাজে ব্যবহৃত যানবাহনের জ্বালানি সরবরাহ ও মেরামত করায় সরকারের অর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ১০ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৯ টাকা।
প্রতিষ্ঠানগুলোর গাড়ির জ্বালানি ও মেরামত বিল/ভাউচার, লগবই ও সংশ্লিষ্ট নথিপত্র যাচাইয়ে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ওই পাঁচটি লাইন ডিরেক্টরের অধীনে পরিচালিত প্রকল্প কাজ বাস্তবায়নে গাড়ির জ্বালানি, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের টাকা দেওয়া হয়। তবে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ গাড়িগুলোর মধ্যে ২০টি প্রকল্পে ব্যবহার না হয়ে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার হতো। এ ক্ষেত্রে বিধিবহির্ভূতভাবে প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে জ্বালানি ও মেরামত ব্যয় নির্বাহ হতো। অপারেশন প্ল্যানের লাইন ডিরেক্টরদের যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা শুধু কর্মসূচি সম্পৃক্ত কাজে ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। কেননা, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে ব্যবহৃত গাড়ির জন্য আলাদা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে অধিদপ্তরের ২৮টি গাড়ি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ব্যবহার করছেন। গাড়িগুলোর বেশিরভাগই পাজেরো (এসইউভি)। এর মধ্যে তিনটি গাড়ি তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও বর্তমান স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দপ্তরে ব্যবহার হয়। এগুলো হলো টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) একটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-০২০২); রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার একটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৫৮৯৮) ও একটি ক্যারিবয় (ঢাকা মেট্রো ঠ-১১-৮৬৬১); রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার আরেকটি ক্যারিবয় (ঢাকা মেট্রো ঠ-১১-৩৬৩৫); স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর একটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৩৫২২) এবং অধিদপ্তরের টিওঅ্যান্ডই-বহির্ভূত একটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৪৮১৩) একই দপ্তরে ব্যবহৃত হয়। ইপিআই কর্মসূচির একটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৮০২৩) স্বাস্থ্যসেবা সচিবের দপ্তর; আরেকটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৮০২২) মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য); রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পাজেরো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৫৮৯৪) স্বাস্থ্য সচিবের একান্ত সচিব এবং একটি ক্যারিবয় (ঢাকা মেট্রো ঠ-১১-৭৪৯৯) মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (বিশ্ব স্বাস্থ্য) ব্যবহার করেন। রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার দুটি পাজেরোর একটি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৫৯৯) যুগ্ম সচিব (প্রকল্প বাস্তবায়ন) এবং অন্যটি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৫৯৩) যুগ্ম সচিব (পার) ব্যবহার করেন। এনসিডিসি শাখার একটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৬৭৭৪); এমআইএস শাখার একটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-০৮১২); হাসপাতাল শাখার তিনটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৯০৮, ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-০৪৪০ ও ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৬০৫৪) এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর দুটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৭৮৫, ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৩৫১০) ব্যবহার করেন যথাক্রমে যুগ্ম সচিব (পার-২), উপসচিব (পার-৩), যুগ্ম সচিব (প্রশাসন), অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল)। স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর দুটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৭৮৫, ঢাকা মেট্রো স্বাস্থ্য ঘ-১৩-৩৫১০) ব্যবহার করেন উপসচিব সংসদীয় কমিটি এবং সচিবের একান্ত সচিব। এমডিসি (মাইক্রোবিয়াল ডিজিজ কন্ট্রোল) কর্মসূচির দুটি ডাবল কেবিন পিকআপ (ঢাকা মেট্রো ঠ-১৩-২৭৭৬, ঢাকা মেট্রো ঠ-১৩-২৭৭৭) এবং দুটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৬৬৬৮, ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৯৪০৩) ব্যবহার করেন উপসচিব (বিশ্ব স্বাস্থ্য-২), উপসচিব (প্রশাসন-১) এবং অতিরিক্ত সচিব, হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো।
চিকিৎসা শিক্ষা শাখার একটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৯৭৪) ব্যবহার করেন অতিরিক্ত সচিব (চিকিৎসা শিক্ষা)। রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার একটি অ্যাম্বুলেন্স (ঢাকা মেট্রো ক-৭১-০৭৪৪) সংসদ সচিবালয়ের মেডিকেল সেন্টারে এবং ইএসডি শাখার একটি পাজেরো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৯১২) ‘পঙ্গু হাসপাতালের সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক ব্যবহার করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাতটি, এমএনসিঅ্যান্ডএইচ কর্মসূচির (ইপিআই) চারটি, জাতীয় পুষ্টি সেবার দুটি এবং এমআইএসের একটি গাড়ির জন্য মাসে জ্বালানি বাবদ অধিদপ্তরের খরচ ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৬ টাকা। এই ১৪টি গাড়ির জ্বালানি খরচ বছরে ৯৮ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। সে হিসাবে ওই ৩১টি গাড়ির জ্বালানি বাবদ অধিদপ্তরের ব্যয় ২ কোটি টাকার বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট লাইন ডিরেক্টররা এ বিষয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রদানে অপারগতা জানান। তবে অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের উপসচিব থেকে শুরু করে যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ক্ষমতার অপব্যবহার করে অধিদপ্তরের গাড়ি ব্যবহার করছেন। মন্ত্রী ও সচিবের দপ্তরের নবম ও দশম গ্রেডের কর্মকর্তারা, এমনকি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীও দীর্ঘদিন ধরে এসব গাড়ি ব্যবহার করছেন। সচিবালয়ের দু-একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অধিদপ্তরের গাড়ি উবারে ব্যবহারের অভিযোগও উঠেছিল।
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সব মন্ত্রণালয় মিলে সরকারি গাড়ি রয়েছে ১ হাজার ৭৫০টি। তবে প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
অডিট অধিদপ্তর নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে এসব লাইন ডিরেক্টর লিখিত জবাব দেন। সেখানে তারা উল্লেখ করেছেন, মন্ত্রণালয়ের আদেশে এসব যানবাহন ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আইন মেনে ব্যয় করা হবে। আরেকজন বলছেন, সচিবালয়ের কাজে গাড়ির জ্বালানি ব্যবহার করা হয়েছে।
সদ্য বদলিকৃত দুজন লাইন ডিরেক্টর বলেন, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে গাড়ি ব্যবহার করেন; জ্বালানি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ড্রাইভার দিতে বাধ্য করেন। তাদের অত্যাচারে কখনো কখনো পকেট থেকে টাকা দিতে হয়েছে। এখন আবার অডিট আপত্তির বোঝাও মাথায় নিতে হয়।
তারা বলেন, অডিট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা সমস্যা বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অপরাধী না করে আমাদের অপরাধী করা হয়েছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, ‘আমি যোগদান করেছি অল্প কিছুদিন। এই বিষয়গুলো এখনো আমার জানা হয়নি।
কথা বলার জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ফোন না ধরে খুদেবার্তা দিয়ে জানান, ভ্রমণরত থাকায় কথা বলতে পারছেন না।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post