৫ যুগেরও বেশি সময় ধরে অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে লালমনিরহাট বিমানবন্দর, বিমান বন্দরের জমি কৃষিফার্ম আর রানওয়েতে ছাগল চড়ান স্থানীয়রা। বৃহত্তম এই বিমানবন্দরটি সংস্কার করে চালু করা হলে পাল্টে যাবে উত্তরাঞ্চলের দৃশ্যপট।
রংপুর অঞ্চলে ঘটবে অর্থনৈতিক বিপ্লব, উম্মোচিত হবে যোগাযোগের ক্ষেত্রের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু কোনো সরকারই এই বিমানবন্দর চালু করেনি। কবে বিমানবন্দর চালু হবে এই আশায় যুগ যুগ ধরে অপেক্ষায় আছেন তিন জেলার মানুষ। ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত লালমনিরহাট বিমানবন্দর পরিদর্শনে আসেন। এরপর বিমান বাহিনীর প্রকৌশলীদের সঙ্গে নিয়ে পুরো বিমানবন্দর ঘুরে দেখেন এবং এর সম্ভব্যতা যাচাই করে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও সিভিল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিয়ে সভা করেন। নতুন করে আশা জাগে লালমনিরহাটের মানুষের মনে। দীর্ঘ অপেক্ষার পরেও আশার আলো দেখেনি লালমনিরহাট বিমানবন্দর।
২০২১ সালে তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি ও বিমান বাহিনী প্রধান, বিমানবন্দরটি পরিদর্শনে এলে আবারো আশার আলো সঞ্চার হয়। তাতেও কোন কাজ হয়নি। পাঁচ যুগেরও বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে লালমনিরহাট বিমান বন্দর। এবারে বাংলাদেশে গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে বিমানবন্দরটি চালু হবে এ আশায় অপেক্ষায় আছেন রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট অঞ্চলের মানুষ। বিমানবন্দরটি চালু হলে রংপুর অঞ্চলে অর্থনৈতিক বিপ্লবের দাড় উন্মোচন হবে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন, সময় ও অর্থ দুটোই বেঁচে যাবে। পাল্টে যাবে উত্তরাঞ্চলের দৃশ্যপট। এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি চালুর দাবি জনিয়েছেন লালমনিরহাটের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
জানা যায়, ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ সরকার নেপাল, ভুটান ও ভারতের অন্তত ১৩টি অঙ্গরাজ্যের যাতায়াত সুবিধার্থে লালমনিরহাটের সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর ও হারাটি এলাকায় এক হাজার ১ শত ৬৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে বিমানঘাঁটি নির্মাণ শুরু করে। তখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে রেলযোগে বড় বড় পাথর ও অন্যান্য সামগ্রী এনে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রানওয়ে ও অবকাঠামোর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নতুন করে ব্যবহার হয়নি। ১৯৫৮ সালে স্বল্প পরিসরে বিমান সার্ভিস চালু হলেও তা বেশিদিন স্থায়ী ছিল না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এটিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেডকোয়ার্টার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। দীর্ঘদিন ব্যবহার না করার কারণে চার কিলোমিটার রানওয়ে, বিশাল টারমাক, হ্যাংগার, ট্যাক্সিওয়ে সবই এখন পরিত্যাক্ত অবস্থায় পরে আছে। বিমানবন্দরের চার কিলোমিটার রানওয়ের চারপাশে কৃষকরা বিভিন্ন ফসল চাষ করছেন। সীমানা প্রচীর না থাকায় রানওয়েতে ছাগল, গরু, ভেড়া চড়াচ্ছেন স্থানীয়রা। এসবের কারণে রানওয়ে নষ্ট হওয়ার পথে। তাই গরু-ছাগল সরিয়ে বিমানবন্দরটি আবারও চালু করার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।
স্থানীয়রা জানান, লালমনিরহাটবাসি বিমানবন্দর চালুর দাবি জানালে বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত লালমনিরহাট বিমানবন্দর পরিদর্শনে এসে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করে সংস্কার কাজ করা হয়, রানওয়ে দিয়ে সর্ব সাধারনের চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। হারাটি ইউনিয়নে কয়েকটি গ্রামের মানুষের রানওয়ের উপড় দিয়ে রাস্তা পারাপার করতেন তা বন্ধ করে দেয় বিমানবাহিনী কতৃপক্ষ। তখন স্থানীয়রা ভেবে ছিল চালু হবে বিমানবন্দর, দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলের মানুষ লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি চালুর বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার শুধু এই অঞ্চলের মানুষকে আশা দিয়ে গেছেন। চালু হয়নি এই বিমানবন্দর। তবে ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী রানওয়ের উত্তর পাশের্^ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড এ্যারোস্পেস বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাই এবারের অন্তর্র^তীকালীন সরকার এই অঞ্চলের মানুষের কথা চিন্তা করে বিমানবন্দরটি চালু করার সিদ্ধান্ত নিবেন।
ব্যবসায়ী মাইদুল সুজন জানান, এক সময় ভুটানের সঙ্গে এ বিমানবন্দরের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু এখন পরিত্যক্ত থাকার কারণে সেটি আর নেই। বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে ভারত, ভুটান ও নেপালের যাত্রীরা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করেন। বিমানবন্দর না থাকায় বাসে বা ট্রেনে যাতায়াত করতে হয় এতে তাদের কষ্ট ও সময় নষ্ট হয়। সেক্ষেত্রে বিমানবন্দরটি চালু হলে সহজেই ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেতে পারবেন তারা। বিমানবন্দরটি চালু হলে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা খুব সহজেই যাতায়াত করতে পারবেন। লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক আলী হাসান নয়ন মুঠোফোনে বলেন, ঢাকার সঙ্গে এই জেলার দুরত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। সড়কে যেতে সময় লাগে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা, কখনও তার চেয়েও বেশি। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি যারা পড়াশোনা করতে যান তাদেরও অনেক অসুবিধায় পড়তে হয়।
একসময় বিমানবন্দরটি দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সেরা বিমানবন্দর হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু অৃশ্য কারণে সেটি বন্ধ হয়ে আছে। এখানকার ব্যবসায়ীরা ঢাকায় যাতায়াত করতে হলে আগে সৈয়দপুরে যেতে হয়। এতে আমাদের অনেক দূর্ভোগ পোহাতে হয়। বিমানবন্দরটি চালু হলে দেশ-বিদেশের পর্যটন ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা নতুনভাবে লালমনিরহাটে বিনিয়োগ করতে পারবেন। সরকার বিমানবন্দরটি চালুর দাবী স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। তিনি আরো জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় এ জেলায় কলকারখানা গড়ে না ওঠার প্রধান অন্তরা হয়ে দাড়িয়েছে।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক নবাগত (ডিসি) এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, আমি এই জেলায় নতুন এসেছি, ইত্যিমধ্যে লালমনিরহাটের বেশকিছু সমস্যার কথা জেনেছি। বিভিন্ন মতবিনিময় সভায় বিমান বন্দর চালুর কথা উঠে এসেছে। আশা করছি এই অঞ্চলের মানুষের যে দাবি সেটি তুলে ধরা হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post