বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর এনআরবিসি ব্যাংক দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে বেনামী শেয়ারহোল্ডার এবং আগের দ-প্রাপ্ত পরিচালকরা। এরা হলেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও এনআরবিসি ব্যাংকের বেনামী শেয়ারহোল্ডার শহীদুল আহসান, এনায়েত হোসেন, আমির হোসেন, সরোয়ার জামান চৌধুরী, এনআরবিসি ব্যাংকের দ-প্রাপ্ত সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলৗ ও ভাইস চেয়ারম্যান তৌফিক রহমান চৌধুরী। বেনামী শেয়ারহোল্ডার ও দ-প্রাপ্ত পরিচালকরা তাদের দুর্নীতির সহযোগী কর্মকর্তাদের নিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সমন্বয়কদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করছেন। বর্তমানে পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়ে তাদের হাতে ব্যাংক তুলে দিতে নানা ধরনে প্রপাগা-ায় লিপ্ত হয়েছে ওই চক্রটি। মূলত নিজের মেয়ে রেহনুমা আহসানকে চেয়ারম্যান বানিয়ে ব্যাংকটিকে দখল করতে চান শহীদুল আহসান।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ৫৩ জন প্রবাসীর নামে এনআরবিসি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয় সরকার। কিন্তু বাংলাদেশে বসবাসরত কতিপয় ব্যবসায়ী জালিয়াতি করে প্রবাসীদের নাম ব্যবহার করে নিজেরা এনআরবিসি ব্যাংকের উদ্যোক্তা বনে যান। এজন্য তারা বাংলাদেশ থেকে প্রথমে অর্থপাচার করে দুবাই, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইতালি নিয়ে যান। আবার ওই সব অর্থ প্রবাসীদের নাম ঠিকানা ব্যবহার করে রেমিটেন্স হিসেবে বাংলাদেশে পাঠিয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কেনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কামরুন নাহার সাখীর নামে শেয়ার কেনেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যার শহীদুল আহসান। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আমির হোসেনের নামে শেয়ার কেনেন আরেক ব্যবসায়ী আরএসআরএম গ্রুপের মাকসুদুর রহমান। এনায়েত হোসেনের ব্যবহার করে উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার হোন সেভেন রিংস গ্রুপের খান মুজিবুর রহমান। যুক্তরাজ্য প্রবাসী সুনাহার আলীর নামে শেয়ার কেনে আওয়ামীলীগের প্রয়াত সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ। সরোয়ার জামান চৌধুরীর নামে থাকা শেয়ারের প্রকৃত মালিক মামুন মুছা মিয়া।
বাংলাদেশ বাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কামরুন নাহার সাখী এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন কিন্তু কোনদিন বাংলাদেশে আসেননি। তার হয়ে পর্ষদে উপস্থিত থাকতেন শহীদুল আহসান নিজে এবং তিনি কামরুন নামে স্বাক্ষর করতেন। শহীদুল আহসান পরিচালনা পর্ষদের উপস্থিত থেকে নিজের নামে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করিয়ে নেন। বেনামে ঋণ পাইয়ে দিতে তাকে সহযোগিতা করনে তৎকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী, ভাইস চেয়ারম্যান তৌফিক রহমান চৌধুরীসহ অন্য পরিচালকরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে বেনামী শেয়ারধারণের বিষয়টি ধরা পড়ার পর কোনঠাসা হয়ে পড়েন শহীদুল আহসান। এরপর গত বছরের ৩১ অক্টোবর নিজের মেয়ে রেহনুমা আহসানের নামে ১ কোটি ৪৫ লাখ শেয়ার কেনেন শহীদুল আহসান। মেয়েকে চেয়ারম্যান বানিয়ে ব্যাংকটিকে দখল করতে মরিয়া উঠেছেন শহীদুল আহসান। তার সিন্ডিকেটে রয়েছে ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারীসহ বিভিন্ন কারণে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হওয়া কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে রয়েছে শাফায়েত ওয়াহেদ, সৈয়দ মহররম হোসেন, মাহফুজুর রহমান, রিয়াজ উদ্দিন আসিফ প্রমুখ।
এদিকে বেনামী শেয়ার ধারণের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৬ সালে উদ্ঘাটন করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বেনামে শেয়ারধারণ আইনত দ-ীয় অপরাধ এবং ওই শেয়ার রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তযোগ্য।
প্রধান উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা, জাতীয় সংসদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থমন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসের প্রেরিতে একাধিক চিঠি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২০ সাল থেকে এনআরবিসি ব্যাংক দখলের চেষ্টা করছেন ওই চক্রটি। আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে চেয়ারম্যান হতে চেয়েছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী। ওই সময় অভিযোগকারীরা নিজেরদেরকে আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মী ও বঙ্গবন্ধুর সৈনিক পরিচয় দিয়ে চিঠি লিখতেন। ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল, পরিচালক এবং ব্যাংকের এমডি-ডিএমডি ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিএনপি-জামায়াত কর্মী হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করতেন। এমনকি শেখ হাসিনার সরকারের উৎখাতের সঙ্গে এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান জড়িত বলেও একাধিক অভিযোগে উল্লেখ করেন দুর্নীতিবাজ চক্রটি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ভোল পাল্টে নিজেরদেরকে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী হিসেবে আবার চিঠি লেখা শুরু করেছেন। বর্তমান চেয়ারম্যান, পরিচালক এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাবেক সরকারের দোসর হিসেবে উল্লেখ করছেন।
এদিকে ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী এবং ভাইস চেয়ারম্যান তৌফিক রহমান সিলেট আওয়ামীলীগের সদস্য। তৎকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী প্রিমিয়ামের টাকায় নিজের পরিবারের ১৬ জন সদস্যদের নামে ব্যাংকের শেয়ার কিনেছেন। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে একক পরিবারের সদস্যদের নামে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার কেনার সুযোগ ছিল না। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে অর্থ আত্মসাতসহ নানা দুর্নীতিতে বাংকটি বন্ধের উপক্রম হয়। সেই পরিচালনা পর্ষদের ৬ পরিচালককে সরিয়ে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরাই আবার ব্যাংকটি দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এদিকে এসব দুর্নীতির খতিয়ে দেখতে গত ২৯ জুলাই এনআরবিসি ব্যাংকে তথ্য তলব করেছে দুদক। ওই চিঠিতে বেনামী শেয়ারহোল্ডার কামরুন নাহার সাখী, এবিএম আব্দুল মান্নান, ফিরোজ হায়দার খান ও আমির হোসেনের পরিচালক নিয়োগ এবং শেয়ার সংক্রান্ত কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। এছাড়া শহীদুল আহসানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এজি এগ্রো, বেগমগঞ্জ ফিড মিলস ও স্টাইলিস গার্মেন্টেসের ঋণ আবেদন, প্রস্তাব, ঋণের বিবরণী, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ইত্যাদি কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী, সাবেক পরিচালক সরোয়ার জামান চৌধুরী, সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ এনায়েত হোসেনের বিরুদ্ধে ভুয়া বিলভাউচার তৈরি করে ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, হুন্ডি, ঋণ প্রদানে অনিয়মের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্তে অনুসন্ধান পরিচালনা করছে দুদক।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post