ভারত মহাসাগরে অবস্থিত সামরিক কৌশলগত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপপুঞ্জ চাগোস অবশেষে মরিশাসের কাছে ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়েছে যুক্তরাজ্য।অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে নিজেদের দখলে রাখার পর এই দ্বীপের স্বাধীনতা দিতে রাজি হয় দেশটি।
এই দ্বীপ নিয়ে কয়েক বছর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতার মধ্য দিয়ে মরিশাস চাগোস ফিরে পেতে যাচ্ছে। শিগগিরই যুক্তরাজ্য ও মরিশাসের মধ্যে এ বিষয়ে চুক্তি সই হবে বলে জানা গেছে। এই নিয়ে মরিশাস অনেক দেনদরবার করেছে।
বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করে।
চাগোস নামে এই গুচ্ছদ্বীপের ভেতরেই রয়েছে সামরিক ও কৌশলগত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছোট্ট আরেকটি দ্বীপ দিয়েগো গার্সিয়া। অনেক বছর ধরে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে গোপন চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের দখলে রেখেছিল। এখানে নৌসামরিক ঘাঁটি ও দূরপাল্লার বোম্বারের এয়ারক্রাফট মোতায়েন করে রাখা হয়।
বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও মরিশিয়ান প্রধানমন্ত্রী এক যৌথ ঘোষণায় বলেছেন, কয়েক দশক ধরে চলে আসা বিরোধের অবসান হতে যাচ্ছে চাগোস দ্বীপ মরিশাসের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। শিগগিরই দুই দেশের মধ্যে চুক্তি সই হবে।
জানা যায়, চাগোস দ্বীপ মরিশাসের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হলেও এর অন্তর্ভুক্ত ছোট ও প্রবলসমৃদ্ধ দিয়েগো গার্সিয়াতে মার্কিন ও যুক্তরাজ্যের ঘাঁটি থেকে যাবে। এই দ্বীপের ঘাঁটির মাধ্যমেই পাশ্চাত্যের ভূরাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভারত এবং চীনের ওপর প্রভাব বিস্তারে সহজ হতো।
বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) যুক্তরাজ্য ও মরিশাসের যৌথ ঘোষণায় চাগোসের স্বাধীনতা দিতে ও পাওয়ার বিষয়ে দুই দেশ সম্মত হওয়ার পার বাকি থাকছে শুধুমাত্র চূড়ান্ত চুক্তি সইয়ের। দুই দেশই জানিয়েছে, খুব তাড়াতাড়ি তারা এ বিষয়ে একটি চুক্তি চূড়ান্ত করবে।
যু্ক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার ও মরিশাসের প্রবিন্দ জগনাথ যৌথ ঘোষণায় বলেন, চুক্তির অধীনে ইউনাইটেড কিংডম দ্বীপপুঞ্জ চাগোসকে স্বাধীনতা দিতে রাজি হয়েছে। এতে করে দ্বীপের মালিকানা ফের চলে যাবে মরিশাসের কাছে। তবে দুই দেশই এই মর্মে সম্মত হয়েছে, দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপটিতে আগের মতোই ঘাঁটি থেকে যাবে এবং সেখানে থেকে অভিযান পরিচালনা করতে পারবে।
এই চুক্তির বলে সেই দ্বীপে ফের বসতি স্থাপন করতে পারবে মরিশাস। তবে দিয়েগো মার্সিয়ায় কোনো বসতি স্থাপন করতে পারবে না মরিশাস।
১৯৬৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্য চাগোস দ্বীপপুঞ্জ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় এবং এখানে বসবাসরত ১ হাজার অধিবাসীকে জোর করে উচ্ছেদ করে। এ ঘটনার জন্য যুক্তরাজ্য ক্ষমাও চেয়েছে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এই মর্মে রায় দেয় যে, চাগোস দ্বীপপুঞ্জে যুক্তরাজ্যের দখল অবৈধ। এই বছরের মে মাসে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটি প্রস্তাব পাস করে। প্রস্তাবে যুক্তরাজ্যকে ৬ মাসের মধ্যে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ মরিশাসকে ফিরিয়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু যুক্তরাজ্য ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়ন করেনি।
চাগোস দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাস
চাগোস দ্বীপপুঞ্জ ভারত মহাসাগরের মাঝখানে প্রায় ৫৮টি ক্ষুদ্র, অত্যন্ত নিচু দ্বীপগুলি নিয়ে গঠিত। জোয়ারের উচ্চতা এবং বালুর স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে দ্বীপের সংখ্যাও পরিবর্তন হতে থাকে।
১৮ শতকের পর থেকে অঞ্চলটি ঔপনিবেশিক দখলে ছিল। কিছুটা সময়ের জন্য ওলন্দাজদের অধীনে এবং পরবর্তী সময়ে ফরাসিদের অধীনে চলে যায়। এই সময় চাগোস দ্বীপপুঞ্জে ব্যাপকভাবে নারকেল গাছ লাগানো হয়। চাগোস দ্বীপের অধিবাসীরা মূলত জোর করে বাধ্যকরা শ্রমিকদের বংশধর। তৎকালীন জনবসতিহীন দ্বীপে বাগানে কাজ করার জন্য তাদের এখানে আনা হয়েছিল।
১৮১৪ সালে প্যারিস চুক্তি সই হলে (যা নেপোলিয়নিক যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়) টোবাগো এবং সেন্ট লুসিয়ার মতো আরা কিছু ফরাসি উপনিবেশের সঙ্গে মরিশাসকে যুক্তরাজ্যের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৬৮ সালে স্বাধীনতা না পাওয়া পর্যন্ত মরিশাস যুক্তরাজ্যের উপনিবেশ ছিল। ১৯৬৮ সালে মরিশাস স্বাধীন হলে স্বাধীনতার ৩ বছর আগে ১৯৬৫ সালে মরিশাসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাজ্য চাগোস দ্বীপপুঞ্জের ওপর নিজেদের দখলে রাখতে সমর্থ হয়।
ল্যাঙ্কাস্টার হাউস এগ্রিমেন্ট নামে পরিচিত চুক্তিটিতে এই আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, ‘ভূমির মালিকদের সরাসরি ক্ষতিপূরণ এবং চাগোস দ্বীপপুঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসনের মূল্যের ওপরে মোট ৩ মিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ মরিশাস সরকারকে প্রদান করা উচিত।’ এই চুক্তির বৈধতা তখন থেকেই প্রশ্নের মুখে পড়ে যখন থেকে মরিশাস এই দাবি করেছে যে, তারা চাপের মুখে পড়ে এই চুক্তি সই করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস এ বিষয়ে জানায়, ‘সে সময়ে মরিশাসের প্রতিনিধিদের প্রকৃত আইন প্রণয়ন বা নির্বাহী ক্ষমতা ছিল না। সে কারণে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি করা সম্ভবপর ছিল না। কারণ, দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা মরিশাসের জনগণের স্বাধীনতা ও মতামতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি। বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাজ্য সরকার চাগোস দ্বীপপুঞ্জ এবং সেই অঞ্চলের বাসিন্দাদের ওপর তার সার্বভৌমত্বের দাবির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলার মুখোমুখি হয়।
এর মধ্যে কয়েকটি মামলা দুটি দেশের সরকারের মধ্যে হলেও চাগোস দ্বীপের অধিবাসীদের তাদের নিজ ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়ার অধিকার সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাই বেশি।
এই সমস্যা ২০০০ সালে বিভাগীয় আদালত বা ডিভিশনাল কোর্ট, ২০০৬ সালে আপিল আদালত এবং ২০০৮ সালে হাউস অব লর্ডস-এর মতো যুক্তরাজ্যের একাধিক আদালতে বেশ কয়েক বছর ধরে চলে।
বিষয়টি ২০১২ সালে ইউরোপীয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস; ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দ্য সি (আইটিএলওএস); ২০১৮ সালে আইসিজে এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তোলা হয়।
বাস্তবে ১৯৮০-র দশক থেকে দ্বীপপুঞ্জের ওপর যুক্তরাজ্যের দখলের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছিল মরিশাস।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post