বেনাপোল বন্দরের ওপারে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে ২৩৪ গ্রাম ওজনের দুইটি স্বর্ণের বারসহ শহিদুল ইসলাম নামে এক ভারতীয় ট্রাক চালক আটক হয়েছে। তবে বাংলাদেশি পাচারকারীর নাম জানা যায়নি। পাচারের ঘটনায় যুক্ত দুই সীমান্তের সিন্ডিকেট সদস্যদের আটকের দাবি জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা।
মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা রাতে আটক শহিদুল ইসলাম বেনাপোল বন্দরে আমদানি করা পণ্য খালাস শেষে স্বর্ণের বার নিয়ে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে ট্রাক নিয়ে প্রবেশ করলে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তাকে আটক করে স্বর্ণের বার উদ্ধার করে। উদ্ধার করা স্বর্ণের বার দুইটি কালো টেপ দিয়ে সাদা কাগজে মোড়ানো অবস্থায় ট্রাকের কেবিনের ভেতর লুকানো ছিল। যার মূল্য আনুমানিক সাড়ে ১৭ লাখ টাকা।
সীমান্ত সূত্রে জানা যায়, আমদানি করা পণ্যবাহী ট্রাকটি (ডব্লিউ-বি-৭৮-৬০৬৪) গত শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) ২১ হাজার কেজি আপেল নিয়ে বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করে। পণ্য চালানটির আমদানিকারক ঢাকার বাণিজ্যালয়। বেনাপোলের সিএন্ডএফ এজেন্ট মেসার্স জারিন এন্টারপ্রাইজ। পণ্য চালানটির ভারতের রপ্তানিকারক এইচ এম ইন্টার ন্যাশনাল এবং সিএন্ডএফ ছিলেন একই প্রতিষ্ঠান। পণ্যচালান খালাসের পর মঙ্গলবার খালি ট্রাক নিয়ে ভারতে ফেরার পথে ট্রাক থেকে স্বর্ণের বার উদ্ধার হয়।
ভারতের ২৪ পরগনা সাউথ বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ারের পাবলিক রিলেশন অফিসার ডিআইজি শ্রী এ কে আর্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বর্ণবারসহ পাচারকারীদের আটকের কথা জানিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, আটক চোরাকারবারী ও জব্দ করা স্বর্ণের বিস্কুট পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পেট্রাপোলের শুল্ক বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কোনো অবস্থাতেই সীমান্তে চোরাচালান বা অন্য কোনো ধরনের অপরাধ ঘটতে দেবে না। এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদেরও ছাড় দেবে না বিএসএফ। চোরাচালান প্রতিরোধে সহযোগিতা কামনা করেন বিএসএফের এ কর্মকর্তা।
ভারতের পেট্রাপোল বন্দর সিএন্ডএফ এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ভারতীয় ট্রাক চালকেরা বেনাপোল বন্দরে একটি চক্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় পাচার কাজে যুক্ত রয়েছে। তবে ওরা ধরাছোয়ার বাইরে থাকায় পাচার অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও জানান, বেনাপোল বন্দরের আমদানি-রপ্তানি গেইটে স্ক্যানিং মেশিন অচল থাকায় প্রতিনিয়ত চক্রটি আরও জোরালোভাবে বাসা বেঁধেছে। ভারত সীমান্তে বিএসএফ সদস্যরা সর্বদা সজাগ থাকাই এখানে এসে মাঝে মধ্যে কিছু স্বর্ণের বার আটক হচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্তে এ অবস্থা চলতে থাকলে আর এসব অবৈধ সিন্ডিকেট চক্রদের রোধ করতে না পারলে দু‘দেশের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা খুবই কষ্টকর হয়ে যাবে। মূলহোতাদের শনাক্ত করতে পারলেই পাচার রোধ সম্ভব হবে।
জানা যায়, বেনাপোল সীমান্তের দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে স্বর্ণ পাচারের ‘গোল্ডেন রুট’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বেনাপোল স্থলবন্দর। তবে স্বর্ণ নিয়ে নির্বিঘ্নে বেনাপোল পার হয়ে গেলেও পেট্রাপোল বন্দর এলাকায় গিয়ে প্রায় ধরা পড়ছে চোরাকারবারীরা।
এদিকে পাচার রোধে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আরও জোরালো পদক্ষেপ নিলেও বাংলাদেশ কাস্টমস ও বিজিবি এনিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। অভিযোগ উঠেছে এসব পাচারে কার্যক্রমে বিজিবি ও কাস্টমসের নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গে চোরাকারবারীদের সখ্য থাকতে পারে। ফলে স্ক্যানিং মেশিন মেরামত বা যাত্রীর ব্যাগেজ তল্লাশিতে অনীহা রয়েছে।
জানা গেছে, বেনাপোল বন্দর দিয়ে বাণিজ্য ও যাত্রী যাতায়াতের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ৪টি স্ক্যানিং মেশিন স্থাপন করে। এর একটি মোবাইল স্ক্যানার স্থাপন হয় বন্দরের বাইপাস সড়কে পণ্য প্রবেশ দ্বারে। অত্যাধুনিক মেশিনটি পণ্যবাহী ট্রাকে আসা রাসায়নিক, মাদক, অস্ত্র ও মিথ্যা ঘোষণার পণ্য শনাক্ত করতে সক্ষম।
এছাড়া বেনাপোল চেকপোস্ট ও রেল স্টেশন আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন-কাস্টমস রুটে চোরাচালান রোধে আরও ৩টি স্ক্যানিং মেশিন বসানো হয়। স্ক্যানিং মেশিনটি কাস্টমসের পক্ষে পরিচালনা করে আসছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাসোসিয়েটস। তবে স্ক্যানিং মেশিনগুলোর মধ্যে ৩টি যান্ত্রিক ক্রুটিতে পড়ায় গেল ৯ মাস ধরে স্ক্যানিং কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে এ পথে। এতে অবাধে আমদানি পণ্য ও পাসপোর্টধারী যাত্রীর মাধ্যমে স্বর্ণ ও মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে চোরাচালান ব্যাপক হারে বেড়েছে। এছাড়া ঢাকা-কলকাতা রুটে যাত্রী নিয়ে চলাচলকারী পরিবহনের অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে চোরাচালানে।
বেনাপোল কাস্টমসের পক্ষে স্ক্যানিং মেশিন তদারকিতে নিযুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাসোসিয়েটসের বেনাপোল অফিস ব্যবস্থাপক বনি আমিন জানান, স্ক্যানিং মেরামত করতে বড় অংকের অর্থের প্রয়োজন। সেটি চুক্তি অনুযায়ী কাস্টমস ব্যয় বহন করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় স্ক্যানিং ৩টির কার্যক্রম বন্ধ আছে।
তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ৬ মাসে অবাধে যাত্রীর কখনো ট্রাক চালকের ছদ্মবেশে বেনাপোল বন্দর ব্যবহার করে পাচারের সময় ৫৭ জন পাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ। এসময় তাদের কাছ থেকে প্রায় ১০০ কেজির কাছাকাছি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়েছে।
এ সময়কালে পাসপোর্টধারী, বাসচালক ও ট্রাক চালকসহ পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত অন্তত ৭০ জন স্বর্ণ মামলায় আটক হয়েছেন। যার বেশির ভাগ ভারতীয়। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর একজন কর্মকর্তা জানান, সীমান্তে বিজিবি সর্বদায় সতর্ক অবস্থায় আছে। মাঝে মধ্যে আমরাও ট্রাক তল্লাশি করি। ট্রাক তল্লাশির কারণে আমদানি-রপ্তানি বন্ধেরও হুমকি দেয়া হয়। তারপরও স্বর্ণ পাচারের খবর আমাদের কাছে এলে আমরা তা আটক করে থাকি।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post