বাংলাদেশে প্রায় ৩৭ ক্যাটাগরির ভিসা রয়েছে। এর মধ্যে বিজনেস (বি), ট্যুরিস্ট (টি), স্টুডেন্ট (এস) ও ভিসা অন-অ্যারাইভাল (ভিওএ) এই চার ক্যাটাগরিতেই আসেন বেশিরভাগ বিদেশি। এরপর বিভিন্ন গার্মেন্ট ও শিল্প কারখানায় কাজ করেন। ভিসার মেয়াদ শেষেও অবৈধভাবে এদেশে থেকে যান। কাজ চালিয়ে যান। ধরা পড়লে জরিমানা গুনতে হয় কম। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে বি ভিসা ও টি ভিসার মেয়াদ অর্ধেকে নামিয়ে আনছে সরকার। বর্তমানে এই দুটি ভিসা দেওয়া হয় ৬০ দিনের। দুটো ভিসাই ৩০ দিনের বেশি দেওয়া হবে না। এছাড়া জরিমানাও বাড়বে।
বিদেশিরা এ দেশের বেকারদের কাছে সুবিধা লুণ্ঠনকারী, পুলিশের কাছে আইনভঙ্গকারী, স্থানীয় পাতি নেতাদের কাছে ফালতু অ-ভোটার হলেও শিল্প-মালিকের কাছে পরিশ্রমী। যে সুযোগ নিয়ে এসব বিদেশি এ দেশে এসে শেকড় গেড়ে বসেন। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে ভিসানীতিতে পরিবর্তন আনছে বাংলাদেশ সরকার। এই বিদেশিরা মূলত বিজনেস (বি), ট্যুরিস্ট (টি), স্টুডেন্ট (এস) ও ভিসা অন-অ্যারাইভাল (ভিওএ) নিয়ে এ দেশে আসেন।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জাল হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ-সংক্রান্ত সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছে সুরক্ষা সেবা বিভাগ।
বিডার বৈঠকে শুধু অবৈধ বিদেশির বিষয়েই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়নি। যেসব সেক্টরে বিদেশি দরকার, সেসব সেক্টরে বিদেশিদের কাজের পথ সহজ করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমানে একজন ওয়ার্ক পারমিটপ্রাপ্ত বিদেশি কর্মী এক কোম্পানি ছেড়ে অন্য কোম্পানিতে যোগ দিতে হলে তাকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। ওই বিদেশিকে বর্তমান কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরে যেতে হয়। দেশে গিয়ে নতুন করে বাংলাদেশে আসার আবেদন করতে হয়। অর্থাৎ আগের প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়পত্র নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিদেশিকে বাংলাদেশ ত্যাগ করে নতুন ভিসা নিয়ে আসতে হয়। এ নীতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে। বিদেশি নাগরিক এ দেশে থেকেই কর্মপ্রতিষ্ঠান বদলাতে পারবেন। এজন্য তাকে অতিরিক্ত ফি দিতে হবে। এ ছাড়া সুরক্ষা সেবা বিভাগ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে বাংলাদেশি ভিসা দেওয়ার প্রক্রিয়া অনলাইনে পুরোপুরি সম্পন্ন করবে। যেসব অবৈধ বিদেশি আছেন তাদের বিরুদ্ধে অঞ্চল নিরপেক্ষভাবে অভিযান চালাবে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ। কর্মরত এই অবৈধ বিদেশিদের জরিমানা করা হবে। যারা অবৈধ বিদেশিদের চাকরি দিচ্ছেন তাদের এবং যেসব বাড়িওয়ালা তাদের কাছে বাড়িভাড়া দিয়েছেন তাদেরও জরিমানা করা হবে। জরিমানার হার নিয়েও কাজ শুরু করেছে সুরক্ষা সেবা বিভাগ।
৬০ দিনের ভিসা ৩০ দিনে নামিয়ে আনলে কীভাবে এই সেক্টরে পরিবর্তন আসবে জানতে চাইলে বিডার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ভিসার মেয়াদ অর্ধেকে নামিয়ে আনলে কিছু প্রত্যক্ষ সুবিধা মিলবে। যারা ৩০ দিনের ভিসায় আসবেন, তারা এক ধরনের মানসিক চাপে থাকবেন। ৩০ দিন দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া এখানে শুধু ভিসার মেয়াদই কমানো হচ্ছে না, আরো কিছু গুচ্ছ সিদ্ধান্ত রয়েছে। সবকিছু মিলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশের উদার ভিসানীতির কারণে কিছু বিদেশি নাগরিক দীর্ঘদিন অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। এতে সরকার রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলায়ও সমস্যা হচ্ছে। তাদের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়। রেমিট্যান্সপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া বর্তমানে জরিমানা দিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদে এ দেশে থাকা যায়। কিন্তু জরিমানার হার খুবই কম। এ জরিমানা বাড়ানোর সিদ্ধান্তও হয়েছে।’
ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই অবৈধ অভিবাসীরা একটা বড় সমস্যা। তাদের সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে তাড়ানোর মিশন নিয়ে অনেক রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। এসব দল হরদমই ওইসব দেশের সরকার গঠন করে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি ঠিক ওই রকম না হলেও পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। এ দেশেও অবৈধ বিদেশিদের নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন কার্যক্রম চালাচ্ছে। এমনই একটি সংগঠন ‘অবৈধ বিদেশি খেদাও আন্দোলন’। এর সভাপতি মুহাম্মদ মহসীন রশিদ বলেন, ‘আমাদের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০ লাখের মতো বিদেশি আছে। তারা ভিজিট ভিসা নিয়ে আমাদের দেশে আসছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। কিছুদিন পরপর নিজ দেশে গিয়ে আবারও ভিজিট ভিসায় বাংলাদেশে আসেন। এভাবে তারা দিনের পর দিন বাংলাদেশে থেকে যাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশিদের কারণে আমাদের ছেলেমেয়েরা চাকরি পাচ্ছে না। প্রতি বছর বিদেশিরা ১০ বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিচ্ছেন। অবৈধ বিদেশিদের দেশ থেকে না খেদাতে পারলে দেশের অর্থ চলে যাবে বাইরে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৩ লাখ ৫০ হাজার। ২০২২ সালের অন্য এক জরিপে বলা হয়েছে, যাদের কোনো শিক্ষা নেই, তাদের বেকারত্ব হাজারে ১৫৩ জন। কিন্তু স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করেও বেকারত্বে ভুগছেন হাজারে ৭৯৯ জন।
অবৈধ বিদেশিদের বিষয়ে গণ অধিকার পরিষদও সোচ্চার। গণ অধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘অনেকেই আমাদের দেশে ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে গার্মেন্টসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক থেকে উচ্চপদে চাকরি করেন। তাদের কেউই ট্যাক্স দেন না। অবৈধ বিদেশিরা দেশের টাকা পাচার করছেন। এর ফলে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে। দেশের কর্মসংস্থানে সংকট তৈরি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে টাকা হলে সব সম্ভব। যারা আমাদের দেশে আসেন তারা তো এয়ারপোর্ট হয়েই আসেন। তাদের একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। ওই মেয়াদে কারা কারা বের হননি তাদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। ফলে বিদেশিরা অবৈধভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।’
বেসরকারি হিসাবে ১০ লাখ অবৈধ বিদেশি থাকলেও সরকারি হিসাবে এ সংখ্যা কত তা জানা যায় না। তবে সরকারের কাছে বৈধদের হিসাব রয়েছে। সরকারি হিসাবে দেশে বৈধ বিদেশি রয়েছেন ২০ হাজার ৯৮৮ জন। তারা ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করছেন। তাদের মধ্যে চীনের ৬ হাজার ৭৫, ভারতের ৫ হাজার ৮৭৬, রাশিয়ার ২ হাজার ৪৬৮, শ্রীলঙ্কার ১ হাজার ২৪৬, দক্ষিণ কোরিয়ার ৯২৪, জাপানের ৫৫৭, পাকিস্তানের ৪১৬, ফিলিপাইনের ৪৬০, থাইল্যান্ডের ৩৯৯, বেলারুশের ৩৭৮, কাজাখস্তানের ২৬৯, আমেরিকার ১৬৮, উত্তর কোরিয়ার ১৩৯, মালয়েশিয়ার ১২৩ ও ইন্দোনেশিয়ার ১০৮ জন রয়েছেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘যেভাবেই হোক অবৈধ বিদেশিদের বাংলাদেশ থেকে বের করে দিতে হবে। তারা যাতে বাংলাদেশে বসবাস করতে না পারেন, সেদিকে সতর্ক থাকতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভিসার মেয়াদ না থাকার পরও এ দেশে অবস্থানকারীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। বিদেশিদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ নিয়ে বৈঠক হয়েছে। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকেও অবৈধ বিদেশিদের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভিসার মেয়াদ পার হওয়ার পরও যেসব বিদেশি নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে রয়েছেন, এ রকম অনেকে কারাগারে রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর তাদের ফেরত নিতে আগ্রহ দেখান না অনেকে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ১২ হাজারের বেশি অবৈধ বিদেশি আছেন বলে তাদের কাছে তথ্য আছে। তারা ফেসবুকে উপহার পাঠানোর নামে প্রতারণা করেন, হেরোইন-কোকেনসহ মাদক কারবার, ব্যাংকের এটিএম বুথের জালিয়াতি, বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রা লেনদেন, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, অনলাইন ক্যাসিনো এবং মানব পাচারে জড়িত।
ওই কর্মকর্তা বলেন, আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে আসা নাগরিকরা ভিসার মেয়াদ শেষ হলে নিজ দেশের পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলেন। অবৈধভাবে বসবাসের জন্য গ্রেপ্তারের পর পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ১৫৭ অবৈধ বিদেশির সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তারা কারাগারে আটক আছেন। ওইসব বিদেশিকে নিজ দেশে পাঠিয়ে দিতে একটি ‘প্রত্যাবাসন ফান্ড’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post