প্রথমে এক বন্ধুর সহায়তায় পরিচয়। সেই পরিচয় থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে কথা বলে ফেলা হয় প্রেমের ফাঁদে। প্রেমের ফাঁদ থেকে কথা দেওয়া-নেওয়া হয়, এরপর বিয়ের প্রলোভনে ফেলা হয়। বিয়ে করবে বলে তার কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মাধ্যমে তাদের প্রেমের সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে। সরল মনে বিয়ের কথা চিন্তা করে মেয়েটির কাছে টাকা পাঠান এক প্রবাসী। এভাবেই প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সাত বছরের সম্পর্ক করে অন্তত পঁচিশ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা তাহেরা আক্তার এর (৩৫) বিরুদ্ধে। তাহেরা আক্তার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক।
ভুক্তভোগী আমেরিকা প্রবাসী যুবকের দাবি, তার এক বন্ধুর মাধ্যমে মোবাইল নম্বরে পরিচয় হয় তাহেরা আক্তারের সাথে, এর সূত্র ধরে পরিবারের সকল সদস্যের সাথে আন্তরিকতা তৈরি হয় ওই যুবকের, এরই মধ্যে মেয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকেন ওই প্রবাসীর সাথে।
প্রবাসীকে কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ের প্রস্তাব দেয় ৷ প্রবাসী সরল মনে রাজি হওয়ার পর থেকে তাহেরা আক্তার প্রবাসীকে নানাভাবে ম্যানেজ করে তার জন্য টাকার কথা বলে প্রবাসী তাহেরাকে বিয়ে করবে এই সরল চিন্তা থেকে ব্যাংক মারফত এবং বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে দফায় দফায় প্রায় পঁচিশ লক্ষ টাকা পাঠায়।
এর বাইরেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে মাসে মাসে টাকা নিত ওই প্রবাসীর কাছ থেকে, একটা সময় পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক চলছিল। তাহেরাও বিদেশ যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। প্রবাসীর আর্থিক সহায়তায় একাধিক পাসপোর্ট এবং আইইএলটিএস করে। কিন্তু মাস দু’ এক ধরে তাহেরা আক্তার অন্য এক ছেলের প্রেমে জড়িয়ে পড়ে এবং প্রবাসী যুবকের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে তাহেরা আক্তার বলেন, আমেরিকা প্রবাসী নজরুল ইসলামের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক নয়, নৈতিক সম্পর্ক ছিল। আমাকে টাকা দিয়েছেন, পাসপোর্ট করিয়েছেন, আইইএলটিএস কোর্স করিয়েছেন, আমি সেই টাকা ফেরত দিয়েছি। তবে ফেরতের ডকুমেন্টস চাইলে তিনি সঠিক তথ্য দিতে পারেননি।
তথ্য গোপন করে বিদেশ যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করেছেন, স্কুলে অনুপস্থিত থেকেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি তথ্য গোপন করে পাসপোর্ট করেছি, এটা প্রবাসী নজরুলই আমাকে ব্লেকমেইল করে বিদেশে নেওয়ার জন্য এসব করেছে।
এদিকে, প্রতিবেদকের হাতে আসা বেশ কিছু ডকুমেন্ট্সে দেখা যায়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তে তারা ভিড়িও কলে একে অপরের সাথে কথা বলছেন। এবং একে অপরের সাথে ভালবাসার কথাবার্তা লিখে এসএমএস করছেন। শিক্ষিকা তাহেরার অশ্লীল ভিডিও-সহ আদান প্রদান করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী নজরুল ইসলামের এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয় তাহেরা আক্তারের। সেই পরিচয় থেকে দুজনের সম্পর্ক প্রেমে গড়ায়। পরে বিয়ের প্রলোভনে দেখিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে মূল্যবান জিনিসপত্র ছাড়াও নজরুলের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে গড়ে তোলেন বিলাসবহুল বাড়ি। এ ছাড়া বড় দুই বোনের চাকরি ও বিয়ের জন্য আনেন আরও ১০ লাখ টাকা। প্রবাসী নজরুলের কাছে যাওয়ার জন্য তার টাকায় আইইএলটিএস সম্পন্ন করেন তিনি।
সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে পরিচয় দিয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই মেশিন রিডেবল (এমআরপি) পাসপোর্ট করেন তাহেরা আক্তার। যদি কারও মাধ্যমে সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থী কোটায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য তিনি নিজেকে শিক্ষার্থী পরিচয়ে ই-পাসপোর্টও করেন। তবে ওই প্রবাসীকে বিয়ে না করে সম্প্রতি সিলেটে আরেক যুবককে বিয়ে করেন তিনি। এই যুবকের সঙ্গেও প্রেম ছিল তাহেরার।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘তাহেরা আমাকে ভালোবাসার অভিনয় করে বিয়ের প্রলোভন দিলে আমিও তাকে ভালোবেসে বিশ্বাস করে আইফোন, মূল্যবান জিনিসপত্রসহ ২৫ লক্ষাধিক টাকা দিয়েছি। সে তার মোবাইল ফোন থেকে আমাকে তার আপত্তিকর ছবি, ভিডিও দিয়েছে। অন্যদিকে একাধিক ছেলের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তোলে। সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। যার প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আমার কাছে আছে।’
তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে সে (তাহেরা) গোপনে বিয়েও করে। তার এমন আচরণে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। সে আমাকে এই বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে নারী নির্যাতনের মামলা দেবে বলে হুমকি দিচ্ছে।’
শিক্ষিকা তাহেরার ঘর নির্মাণ কাজের ঠিকাদার কপিল মিয়ার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাহেরার ঘর নির্মাণ কাজের সময় প্রবাসী নজরুল ইসলাম সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করতেন আমার সাথে, ঘরের ডিজাইনে আমাকে পরামর্শও দিতেন, নির্মাণ কাজে টাকা পয়সা দিয়েছেন ঠিক আছে, তবে কত টাকা দিয়েছেন, তা বলতে পারবনা।
তিনি বলেন, তাহেরা আক্তার এর কাছে আমার ঘর নির্মাণ কাজের পাওনা রয়েছে, এ নিয়ে তার সাথে আমার সাথেও ঝামেলা হয়েছে। রাছিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুপ্রীতি রাণী দাস বলেন, তাহেরার ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বার প্রায়ই বন্ধ করে রাখে। কেন, বন্ধ রেখেছেন, আমরা আপনাদের মাধ্যমে জেনেছি। আগে এসব কিছু আমি জানতামনা।
তবে তাহেরা নিয়মিত স্কুলে আসছেন ক্লাসও করছেন। তার মোবাইল নাম্বার বন্ধ থাকাটা, কারো সাথে সম্পর্কের ব্যপার হচ্ছে একান্তই ব্যক্তিগত। প্রবাসী নজরুল ইসলাম ও প্রধান শিক্ষক সুপ্রীতি রাণী দাস’র একটা মোবাইলে কল রেকর্ড থেকে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক সুপ্রীতি রাণী দাস বলেন, তাহেরা যে ঘর নির্মাণ করেছে, উপজেলার যে শিল্পপতি আছেন, তার ঘরটাও এত উন্নত নয়, তাহেরার ঘরটা এত উন্নত করে করা হয়েছে। আলাপের এক পর্যায়ে প্রধান শিক্ষক তাহেরার সাথে প্রবাসী নজরুল ইসলামের লেনদেনসহ সবকিছু নিয়ে কথা বলবেন এমন আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহন লাল দাস বলেন, বিষয়টি জেনেছি, আমরা তাহেরাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছি। জেলার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মনিরুজ্জামান এর সাথে দেখা করে কথা বলে জানা যায়, একাধিক পাসপোর্ট করা ঠিক আছে, তবে স্টুডেন্ট পরিচয়ে দ্বিতীয় পাসপোর্ট করা ঠিক হয়নি বলে জানান তিনি।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post