বলকান অঞ্চলের ইউরোপের ট্রানজিট প্রধান দেশ স্বাধীন রাষ্ট্র সার্বিয়া। দেশটির অর্থনীতির বেশ কিছু খাতে চলছে গুরুতর শ্রমিক সংকট। এমতাবস্থায় দেশটিতে অবস্থানরত অভিবাসীদের নিয়োগ করতে চাইছে সরকার। এতে সেই অভিবাসী যে কোনো দেশের হতে পারে এমনকি বাংলাদেশেরও।
ট্রানজিট দেশ হওয়ায় দেশটির মধ্যে দিয়ে প্রতি বছর হাজারো আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থী পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে যেতে অপেক্ষায় থাকে। এবার আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থীকে কর্মী বানিয়ে আটকাতে চাচ্ছে সার্বিয়া।
জানা গেছে- গণপরিবহন, নির্মাণ ও হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বেশ কিছু খাতে হন্য হয়ে কর্মী খুঁজছেন সার্বিয়ার নিয়োগকর্তারা। পর্যাপ্ত কর্মী না থাকায় ঝিমিয়ে পড়েছে পরিচিত এসব খাত। দেশটির সরকারের ধারণা, প্রতি বছর আনুমানিক ৩০ হাজার সার্ব নাগরিক দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। যাদের মধ্যে বড় একটি অংশ তরুণ।
সার্বিয়ান এমপ্লয়ার্স ইউনিয়নের মুখপাত্র জেলেনা জেভটোভিচের মতে, ‘কিছু কিছু কোম্পানি নতুন নিয়োগকারীদের স্বাগত জানাতে এবং তাদের অবস্থান সংহত করার জন্য বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করছে। যেমন বিদেশি কর্মীদের জন্য অনুবাদক ও দোভাষী নিয়োগ করা।
অনেক নিয়োগকর্তারা বিদেশি কর্মচারীদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলেন। কিন্তু সবাই ইংরেজি জানেন না। ইংরেজিসহ অন্য কোনোভাবে যখন কাজ চালানো যায় না, তখন নির্মাণ খাতের মতো সেক্টরগুলোতে কর্মীদের কাজ বুঝিয়ে দিতে দোভাষী নিয়োগ আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সার্বিয়া যদি বিদেশি শ্রমিকদের দেশটিতে আকর্ষণ করতে চায় সেক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই প্রতিবেশী ক্রোয়েশিয়ার মতো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্রোয়েশিয়া শ্রম ঘাটতিতে থাকা সেক্টরে বিদেশি কর্মীদের স্বাগত জানাতে অনেক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে। বিদেশিদের জন্য ক্রোয়েশিয়ান ভাষা শেখার কোর্সের ব্যবস্থাও করেছে দেশটির কিছু কিছু কোম্পানি।
ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগরেবের স্থানীয় সরকারের সাংসদ গর্ডান বোসানাকের মতে, ‘‘জাগরেব শহরের জন্য এই সিদ্ধান্তটি অপরিহার্য ছিল। কারণ ক্রোয়েশিয়ান ভাষা শেখা হল বিদেশি কর্মীদের ইন্টিগ্রেট বা একীকরণের প্রথম পদক্ষেপ। দেশে সক্রিয় অভিবাসীদের হার ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় বাড়ছে।
এই সংসদ সদস্য বলেন, জাগরেব শহরে বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২৩ হজার। তিনি আরো বলেন, এ জাতীয় সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় সরকারের একীকরণ ব্যবস্থার জন্য অপেক্ষার করা শহরগুলোর উচিৎ নয়।
সম্প্রতি প্রকাশিত ফোর্বস সার্বিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে অন্তত ৫০ হাজার অভিবাসী বৈধভাবে সার্বিয়ার কাজের ভিসায় এসেছেন। প্রতি বছর এই সংখ্যা বাড়লেও বিদেশি কর্মীদের জন্য সরকার এখনও ইন্টিগ্রেশনস কোর্স ও ভাষা শেখানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
ফোর্বস সার্বিয়াকে দেশটির ন্যাশনাল এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিস জানিয়েছে, সার্বিয়াতে এখনও ক্রোয়েশিয়ার মতো কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়নি। বেলগ্রেডের বেসরকারি পরিবহন কোম্পানি আরিভা শ্রীলঙ্কা থেকে বেশ বাস চালককে নিয়ে এসেছে।
কোম্পানিটি বলছে, ‘‘আমরা আমাদের চালকদের জন্য নিজেরা প্রশিক্ষণের আয়োজন করে আপাতত সমস্যার সমাধান করেছি। এই কোর্সটি তিন মাস স্থায়ী হয়েছিল। অভিবাসীরা কোর্স চলা অবস্থায় ধীরে ধীরে ভাষা শিখতে শুরু করেছিল।
সার্বিয়ান ব্যবসায়ী সমিতির মুখপাত্র জেলেনা জেভটোভিচ বলেন, ‘‘আমরা কর্মীদের ভাষা সমস্যা নিয়ে অবগত। আমাদের একটি ঠিকাদারের কোম্পানিতে তুরস্কের নির্মাণ শ্রমিকরা কাজ করে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাদেরকে ভাষা শেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি একজন দোভাষী নিয়োগ করেন। যিনি প্রতিদিন নির্মাণ সাইটে এসে কর্মীদের সাথে কথা বলেন।
তবে এভাবে সমস্যার সমাধান করা সবসময় সম্ভব নয়। বিশেষ করে অনেক কর্মীর সার্বিয়ান ভাষা শেখার ইচ্ছা নেই। দেশটির নিয়োগকর্তাদের মতে, শুধুমাত্র পথে সার্বিয়ায় থাকা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সরকার যদি প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করে সেটি জটিল হবে। কারণ অনেকেই সার্বিয়া থেকে চলে যেতে সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।
জেলেনা জেভটোভিচ বলেন, একদল কিউবান শ্রমিকের একটি ঘটনা আছে। তারা হোটেল সেক্টরে কাজের ভিসা নিয়ে এসেছিল। তারা প্রথম দুদিন কাজের জায়গায় হাজির হয়েছিল। কিন্তু তৃতীয় দিনের মাথায় তারা স্পেন এবং যুক্তরজ্যে চলে যায়।
তিনি বলেন, বিদেশিদের কর্মসংস্থানের নতুন আইন নিয়ে কাজ করার সময় ভাষা শেখার বিষয়টি নিয়ে মোটেও আলোচনা করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এমন উদ্যোগ অল্প সময়ের জন্য সার্বিয়ায় আসা কর্মীদের সাথে কাজ করবে না। এটি তাদের সাথে হতে পারে যারা এখানে স্থায়ী বা দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকবেন। সত্যিই যদি তারা তিন মাস সার্বিয়ায় থাকেন তাহলে তারা আসলে কিছুই শিখতে পারবে না।
নির্মাণ শ্রমিকদের স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়নের মুখপাত্র সাসা তোরলাকোভিচ বলেন, উদাহরণস্বরূপ, নেদারল্যান্ডে শ্রমিকদের সাংকেতিক ভাষা শেখানো হয়। কারণ একটি নির্মাণ সাইটে ১০ থেকে ১২ দেশের শ্রমিক কাজ করেন। দেশটি শ্রমিকদের থাকার জন্য দশ লাখ হাউজিং ইউনিট তৈরি করছে। তিনি দাবি করেন, সার্বিয়াতে কেউ এখনও আবাসন ও ভাষাজনিত সমস্যা নিয়ে গুরুত্ব সহকারে কাজ করছে না। আবাসনের ভার প্রায়ই শ্রমিকদের ওপর অথবা তাদের নিয়োগকর্তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।
সাসা তোরলাকোভিচ ব্যখ্যা করেন , বর্তমানে নির্মাণ খাতে কর্মীদের গ্রুপের একজন ইংরেজিতে কথা বলে এবং তার মাধ্যমে সবাই যোগাযোগ করছে। আমাদের কাছে যখন সাব-কন্ট্রাক্টররা আসেন তখন কর্মীদের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তাই কীভাবে নেপালি, ভারতীয় অথবা ইন্দোনেশিয়ানদের সাথে চুক্তিতে আসা যায়; যাতে অভিবাসী শ্রমিকেরা এখানে নিরাপদ বোধ করে সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। অনেকেই জানে না সমস্যায় পড়লে কার কাছে যেতে হবে। আমার ধারণা ছিল তাদের কাছে তাদের মাতৃভাষায় নির্দেশিকা ছাপিয়ে ছড়িয়ে দেয়া। ভাষা না জানার পরিণতি সর্বোপরি একটি বিশাল নিরাপত্তা সমস্যা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সার্বিয়ায় বিদেশিদের কর্মসংস্থান সংক্রান্ত নতুন আইনের আওতায় ওয়ার্ক পারমিট পাওয়া সহজ হবে বলে জানিয়েছে ফোর্বস সার্বিয়া। নতুন আইনে, রেসিডেন্স পারমিটের অনুমতি এবং ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার পদ্ধতিকে একীভূত করা হবে। পুরো প্রক্রিয়া সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ স্থায়ী হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে সার্বিয়ার বর্তমান আইন অনুসারে, কাজের ভিসায় দেশটিতে আসা একজন বিদেশিকে অবশ্যই হোটেল বা হোস্টেলে চেক ইন করতে হবে এবং পুলিশের কাছে গিয়ে নিবন্ধিত হয়ে তারপর রেসিডেন্স পারমিটের জন্য আবেদন জমা দিতে হয়।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post