ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (ইউএনও) স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন)। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর বেজায় চটেছেন ফরিদপুর-৪ আসনের এই সাংসদ।
নির্বাচনের পর তিনি স্থানীয় প্রশাসনকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেটরা ভবিষ্যতে তার নেতাকর্মীদের কোনো কাজে বাধা দিলে হাত-পা ভেঙে দেয়া হবে।’ এমনকি নির্বাচন কমিশন ১২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়ায় ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) অতুল সরকারের কাছে কৈফিয়ত তলব ও তাকে গালাগাল করেন। ডিসি-ইউএনওসহ নির্বাচনে দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অত্যন্ত মানহানিকর ও অশ্রাব্য ভাষায় হুমকি ও গালিগালাজ করেছেন তিনি ও তার অনুসারীরা।
নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করায় তার একজন কর্মীকে স্বল্পসময়ের জন্য আটক করায় চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে গালাগাল করেন নিক্সন চৌধুরী। বিষয়টিকে নির্বাচনী আচরণবিধির পরিপন্থী উল্লেখ করে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দিয়েছেন ফরিদপুরের ডিসি অতুল সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়সহ অফিসপাড়ায়।
সোমবার ইসিতে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, ১০ অক্টোবর চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয় সহকারী রিটার্নিং অফিসারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়।
এ বিষয় নিয়ে হুমকি, মিথ্যা, মানহানিকর ও অশালীন বক্তব্য দেন স্থানীয় সংসদ সদস্য (স্বতন্ত্র) মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন), চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের বিজয়ী চেয়ারম্যান মো. কাউছার এবং তার অনুসারীরা। তাদের এহেন আচরণ উপজেলা পরিষদ (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা-২০১৬ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন মর্মে প্রতীয়মান হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
এর আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে ডিসি অতুল সরকার বলেন, নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়ায় ডিসি অতুল সরকারের কাছে টেলিফোনে কৈফিয়ত তলব করেন মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন)। ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়ার কারণে তার সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয় হলে মহাসড়ক অবরোধসহ নানা ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন তিনি।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোববার (১১-অক্টোবর) দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, ফরিদপুর শাখার জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ফরিদপুরের ডিসি, ইউএনও ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে অশালীন আচরণ এবং দুর্ব্যবহার করার বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানানো হয়।
আরো পড়ুনঃ মানব সেবার আড়ালে ওমানে কোটি টাকার জালিয়াতি
এতে বলা হয় শনিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিক্সন চৌধুরীর সমর্থিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ১১ হাজারের বেশি ভোটে বিজয় লাভ করেন। কিন্তু রাত সাড়ে ৮টায় নির্বাচন পরবর্তী জনসভায় নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে বিজয়ী প্রার্থী মো. কাওছার ও সংসদ সদস্য এবং তার অনুসারীরা ১২ জন ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েনের কথা উল্লেখ করে জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলেন। নিক্সন চৌধুরীর অনুসারীরা বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেন যা একজন সংসদ সদস্য বা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে অকল্পনীয়।
সভায় উপস্থিত সবাই একমত হন যে, সরকারের সিদ্ধান্ত ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান জেলা প্রশাসনের প্রতি এহেন আচরণ অত্যন্ত অবমাননাকর। এ ধরনের হীন বক্তব্য স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে সরকারের সাফল্য সম্পর্কে ভুলবার্তা দেবে। তেমনি মাঠপ্রশাসনের সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করার পথেও চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। এ ধরনের ঘটনার প্রতিকার না হলে মাঠপ্রশাসনের সব ধরনের কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। এরপর জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় নিক্সন চৌধুরীর এমন আচরণের জন্য নিন্দা প্রস্তাব উপস্থাপন করলে তা পাস হয়। আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপস্থিত সব সদস্য এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রম বাজার ওমান
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ওই সভার রেজুলেশনের কপি বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদকে পাঠানো হয়েছে। অনুলিপি দেয়া হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সব সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, ইউএনওসহ সংশ্লিষ্টদের।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ রোববার রাতে যুগান্তরকে বলেন, একজন সংসদ সদস্যের কাছে এ ধরনের আচরণ আমরা কখনোই আশা করি না। ভাঙ্গার একজন নারী ইউএনওর সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেছেন যা অবর্ণনীয়।
আরো পড়ুনঃ সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন বহু ওমান প্রবাসী
উপজেলা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। সেখানে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে এমন অশ্রাব্য ভাষায় ডিসিসহ জেলা প্রশাসনকে গালাগাল করতে হবে। একজন সংসদ সদস্য হয়ে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করে প্রকাশ্যে ‘ডিসির গালে গালে-জুতা মার তালে তালে, ডিসির চামড়া তুলে নেব আমরা’ আমার চাকরি জীবনের ২৫ বছরে এমন ঘটনা দেখিনি-শুনিনি। আমরা এ ধরনের আচরণের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানাই। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হয়েছে। তিনি নিশ্চয়ই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post