ওমান সরকার বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য সব ধরনের ভিসা বন্ধ করে দেয় গত বছরের নভেম্বরে। এর ফলে ওমানের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো বন্ধ রয়েছে। শিগগিরই তা চালু হওয়ার সম্ভাবনা কম। কর্মসংস্থানের চেয়ে দ্বিগুণ কর্মী যাওয়ায় ও ভিসার অপব্যবহারের কারণে গত ৩১ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য এই ব্যবস্থা নিয়েছে ওমান।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা যায়, কবে নাগাদ এই ভিসা চালু হতে পারে, তা অনিশ্চিত। তবে ভিসা চালুর জন্য গত ডিসেম্বরে সরকারের পক্ষ থেকে ওমানে একটি খসড়া সমাঝোতা স্মারক পাঠানো হয়। তবে এ ব্যাপারে ওমান সরকারের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
অভিবাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এই শ্রমবাজার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে এবং নতুন শ্রমবাজার খুলতে না পারলে জনশক্তি খাতে সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি হবে। বিএমইটি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য তৃতীয় শ্রমবাজার হিসেবে পরিচিত ওমানে গত বছর এক লাখ ২৭ হাজার ৮৮৩ জন কর্মী গেছেন, যা মূল শ্রমবাজারে যাওয়া কর্মীর ৯.৮০ শতাংশ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওমানে প্রায় ২০ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের মধ্যে আট লাখের বেশি বাংলাদেশি। তাদের বেশির ভাগ এখন বেকার। অনেকে কাজ খুঁজতে গিয়ে দালালদের খপ্পরে পড়ছেন। দালালদের মাধ্যমে ইরান বা তুরস্ক হয়ে ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে তাঁরা পাচারের শিকার হচ্ছেন।
ওমানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে কর্মীরা ওমানে আসেন। কিন্তু এখানে কাজ না পেয়ে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হয়। এক পর্যায়ে এসব কর্মী নানা ধরনের অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি ওমানি নাগরিকদের মারধরের অভিযোগও রয়েছে।
সম্প্রতি ওমানে একজন তরুণের বিপরীতে পাঁচজন বিদেশি কর্মী নিয়োগের অনুমোদন দেয় দেশটির সরকার। এতে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা বেশি ছিল। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে মানব পাচারকারী চক্র বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়ে আসে। তাঁদের অনেকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না পেয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এতে ভিসার অপব্যবহারের বিষয়টি উঠে আসে। ওমান সরকার বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য সব ধরনের ভিসা স্থগিত করে।
দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলছেন, ওমানে বাংলাদেশি সব কর্মীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার পর বন্ধ হওয়া ভিসা চালু হতে পারে।
বাজার বন্ধের শঙ্কায় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো
ওমানের শ্রমবাজার বন্ধের আশঙ্কা করছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। এইচপি ওভারসিজ দীর্ঘদিন ধরে ওমানে কর্মী পাঠিয়ে আসছে। এর স্বত্বাধিকারী প্রবীর বণিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ওমানের শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা প্রতিবছর যতসংখ্যক কর্মী পাঠাতাম, ততসংখ্যক আর পাঠাতে পারব না। এখন রেমিট্যান্সের পরিমাণও কমে যাবে। এই ক্ষতি পোষাতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।’
আরেক রিত্রুদ্ধটিং এজেন্সি মিস্টার ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী ও এম এম হামিদুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা যেহেতু বেশির ভাগ কাজ এই শ্রমবাজার ভিত্তিক করতাম, এ জন্য আমরা বড় ক্ষতির শিকার হয়েছি। আমাদের এখন বসে থাকার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কর্মীরা এখন কী করবেন, কোন দেশে যাবেন, তাঁরা সেই চিন্তায় পড়ে গেছেন।’
এই শ্রমবাজার চালু করতে হলে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের সভাপতি আবুল বাশার। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের মন্ত্রী-সচিব দুজনই নতুন। আমরা তাঁদের সঙ্গে ওমানের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। মন্ত্রী সম্ভবত আবুধাবি যাচ্ছেন। সেখান থেকে হয়তো এ বিষয়ে আলাপ করতে পারেন। এখানে আমাদের পক্ষ থেকে কিছু করার নেই। সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব গাজী মো. শাহেদ আনোয়ার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা তো সমাঝোতা স্মারকের খসড়া পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের কাছ থেকে চূড়ান্ত কিছু পাওয়া যায়নি। তবে আমরা তাদের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছি। সমাঝোতা স্মারক চূড়ান্ত হলে কর্মীরা কবে যেতে পারবেন, সেটি ঠিক করা সম্ভব হবে।’
এ বিষয়ে অভিবাসন গবেষণা সংস্থা রামরুর প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন ড. তাসনিম সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এককেন্দ্রিক বাজার ব্যবস্থার কারণে একটি শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেলে আমরা সমস্যার মধ্যে পড়ে যাই।
আমার দেখা মতে কোনো বছর সব কর্মী সৌদি আরব গেছেন, আবার কোনো বছর সব কর্মী মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ওমানে গেছেন। এতে বোঝা যায়, বাজারটা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। ওমানের বাজার বন্ধ হলে এই শ্রমবাজার আরো বেশি সংকুচিত হবে। এটা জনশক্তি রপ্তানির জন্য ভালো নয়। যতই বাজার ছড়ানো সম্ভব হবে, তত আমাদের শ্রমবাজার উন্মোচিত হবে।
কিন্তু আমরা যা করি, যেকোনো বাজারে এত বেশি কর্মী পাঠাতে থাকি এবং এত অব্যবস্থাপনা তৈরি করতে থাকি যে কিছুদিনের মধ্যে বাজারটি বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর যেমন দায় নিতে হবে, তেমনি সরকারেরও অনুমোদন দেওয়ার সময় চিন্তা করে দেখতে হবে।’
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।
Discussion about this post