একদিন, বিছানায় শুয়ে, তু চ্যাংওয়াংয়ের মনে হলো, তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে কিছু একটা করতে হবে। তিনি একজন খ্যাতিমান চীনা বিজ্ঞানী এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র হিসেবেও কাজ করেন। তিনি জানেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন একটি গুরুতর সমস্যা যা সমগ্র বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
তবে তিনি এটাও বলেন যে, এই উষ্ণায়ন প্রক্রিয়াকে তিনি সৌর ক্রিয়াকলাপের একটি চক্রের অংশ হিসাবে দেখেন যা সম্ভবত কোনো এক সময় আবার স্বাভাবিক হলেও হতে পারে। কলামে আরও একটা ব্যাপার উঠে আসে। বর্তমানে যেমনটা মনে করা হয় যে, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে এবং যার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, তু চ্যাংওয়াং তেমনটা মনে করতেন না।
পিপল’স ডেইলি’র যে সংখ্যায় কলামটি প্রকাশিত হয়েছিল, সেই সংখ্যায় মূল প্রবন্ধ শুরু হওয়ার কয়েক পৃষ্ঠা আগেই অনেকটা প্রচ্ছদ ছবির মতো একটি ছবি ছাপা হয়। যে ছবিতে ছিল মূলত একদল হাস্যোজ্জ্বল কয়লাখনি শ্রমিক। ছবিটার মাধ্যমে সেই ১৯৬১ সালেই চীন সম্পর্কে পুরো বিশ্ব একটি বার্তা পেয়েছিল। বার্তাটি হলো, চীন দ্রুতই শিল্পায়নের দিকে এগোচ্ছে। মূলত সেই ৬০-এর দশকেই দেশটি অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিমা বিশ্বকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করে।
প্রায় সাত দশক পর চীন আজ বিশ্বের অন্যতম প্রধান শিল্পোন্নত দেশ। বর্তমান বিশ্বের মোট উৎপাদনের এক চতুর্থাংশই ঘটছে এশিয়ার এ দেশটিতে। যা যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির সম্মিলিত উৎপাদন থেকেও বেশি। কিন্তু একটা দিক দিয়ে দেশটির এই অগ্রগতির জন্য বিশ্বকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। সেই দিকটা হলো জলবায়ু পরিবর্তন তথা বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ বা কার্বন নিঃসরণ।
যে সময়টায় চীনে সবচেয়ে বেশি শিল্পায়ন হয়েছে অর্থাৎ গত তিন দশকে চীন বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করেছে। মার্কিন গবেষণা সংস্থা রোডিয়াম গ্রুপের তথ্য মতে, বর্তমানে সারাবিশ্বে প্রতিবছর যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়, তার চার ভাগের এক ভাগেরও বেশি করছে চীন। যা বিশ্বের প্রথম সারির শিল্পোন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণেরও বেশি। অর্থাৎ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে চীন এখন এক নম্বর আর যুক্তরাষ্ট্র দুই নম্বর।
কার্বন নিঃসরণকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ অভিহিত করে বেশ কয়েক বছর ধরে এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়ে আসছেন জলবায়ু বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদরা। তারই প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলনে একটি চুক্তি গৃহীত হয়।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নামের ওই চুক্তিতে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের সরকার বৈশ্বিক উষ্ণায়ন শিল্প বিপ্লবের যুগের আগের অবস্থায় তথা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। যা বাস্তবায়নে গত কয়েক বছর ধরে চেষ্টা-তদবির চলছে। কিন্তু এক্ষেত্রে খুব একটা যে উন্নতি হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না। অন্তত কার্বন নিঃসরণের সাম্প্রতিক চিত্র সেটাই বলছে।
বিশ্বকে যদি প্রকৃত অর্থেই উষ্ণায়নকে শিল্প বিপ্লব যুগের আগের অবস্থায় অর্থাৎ ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামিয়ে আনতে হয়, তাহলে এর জন্য অনেকাংশেই তাকে চীনের ওপর নির্ভর করতে হবে। এ বছর বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। যা গত ৩০ নভেম্বর শুরু হয়েছে। সম্মেলনে যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের জন্য চীনের পক্ষ থেকে ভাল ও খারাপ দুই ধরনের খবরই রয়েছে।
ভাল ও ইতিবাচক খবর হচ্ছে, চীনের কার্বন নিঃসরণের বৃদ্ধি খুব শিগগিরই বন্ধ হয়ে যাবে। কয়েকজন বিশ্লেষক বলছেন, দেশটির কার্বন নিঃসরণ চলতি বছরই শীর্ষে বা চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছবে। সেটা ঘটবে ২০৩০ সালের আগেই। বিষয়টা নিয়ে খুব কমই সন্দেহ আছে বিশেষজ্ঞদের। চীনও ২০৩০ সালকে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। অর্থাৎ এরপর তাদের নিঃসরণ কমতে থাকবে।
এটা ঘটবে মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য বা সবুজ জ্বালানিতে যাওয়ার মাধ্যমে। এই মুহূর্তে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় দ্রুত গতিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে চীন। তারা নবায়নযোগ্য শক্তি তথা জ্বালানিতেও প্রচুর বিনিয়োগ করছে। এই মুহূর্তে তাদের প্রায় ৭৫০ গিগাওয়াট বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ।
এখানেই শেষ নয়, চীন সরকারের লক্ষ্য, চলতি দশকের শেষ নাগাদ এই সক্ষমতা ১ হাজার ২০০ গিগাওয়াটে উন্নীত করা যা এই মুহূর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে বেশি। চীন সম্ভবত সেই লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাবে। এমনটাই মনে করা হচ্ছে।
তবে শুধু নবায়নযোগ্য বা সবুজ জ্বালানিই নয়, আরও কয়েকটি ব্যাপার চীনকে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে সহায়তা করবে। যেমন যে ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্প থেকে ব্যাপক কার্বন নিঃসরণ ঘটে সেই ইস্পাত ও সিমেন্ট উৎপাদন ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এছাড়া গত কয়েক দশক ধরে সরকার দেশজুড়ে যে সড়ক ও রেল যোগাযোগ নির্মাণযজ্ঞ চালিয়ে আসছে, সেই বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পে আগের চেয়ে কম ব্যয় করছে।
দীর্ঘদিন ধরে রিয়েল এস্টেট খাতের যে ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে, সম্প্রতি অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সেটাও থমকে গেছে। যা চীনের জন্য খারাপ বা নেতিবাচক বিষয় হলেও বিশ্বের জলবায়ু পরিস্থিতির জন্য অবশ্যই ইতিবাচক খবর। কারণ নতুন নতুন আবাসিক ভবন নির্মাণ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় আগের চেয়ে কার্বন নিঃসরণও কমে যাচ্ছে।
কার্বন নিঃসরণ চূড়ান্ত অবস্থায় যাওয়ার চেয়ে যেটা বেশি গুরুত্ব, সেটা হলো এরপর যা ঘটতে যাচ্ছে। চীন এরই মধ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা আগামী ২০৬০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাসের নেট নির্গমন নির্মূল করে ‘কার্বন নিরপেক্ষ’ দেশে পরিণত হবে। ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর এক ভিডিও সংযোগের মাধ্যমে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশের উচ্চ পর্যায়ের বিতর্কে অংশ নিয়ে এই প্রতিশ্রুতি দেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
তিনি বলেন, ‘চীন ২০৩০ সালের পর থেকে কার্বন নির্গমন হ্রাস শুরু করবে এবং ২০৬০ সালের মধ্যে একটি কার্বন নিরপেক্ষ দেশে পরিণত হবে। এই দুটি লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে গেলে কঠিন প্রয়াস প্রয়োজন, তবে চীন যথাযথ প্রচেষ্টা চালাবে। তাছাড়া, উন্নয়নশীল দেশসমূহকে সুবজ ও কার্বন নিঃসরণ কমাকে ব্যাপক সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যাবে এবং দেশে কিংবা বিদেশে আর কোনো নতুন কয়লা-চালিত প্রকল্প নির্মাণ করবে না চীন।’ কার্বন নিরপেক্ষ হওয়া মানে কার্বন নিঃসরণ ও বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন শোষণের মধ্যে ভারসাম্য রাখা।
তবে চীনের জন্য এটা বেশ কঠিন একটা লক্ষ্যমাত্রাই হবে। এমনকি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগের পরও চীনের অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে কয়লা থেকেই। এটি ২০১১ সালের প্রায় ৭০ শতাংশ থেকে কম। কিন্তু বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে চীনে কয়লা পোড়ানোর পরিমাণও বাড়ছে। গত বছর চীন রেকর্ড ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করেছে এবং গড়ে প্রতি সপ্তাহে প্রায় দুটি নতুন কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দিচ্ছে।
তবে আশার কথা হচ্ছে, অনুমোদিত এসব কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনেকগুলো নির্মিত নাও হতে পারে। এর কারণ এরই মধ্যে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, সেগুলোর উপযোগিতার হার দ্রুত কমছে। যা নতুন করে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ অনুৎসাহিত করছে। তবে চীন কয়লা থেকে ততটা দ্রুত সরে আসছে না যতটা দ্রুত পরিবেশবাদীরা চাইছেন বা বিশেষজ্ঞ যেমনটা বলছেন যে, ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আরও দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
সমস্যাটি হলো চীনের অনেক কয়লা রয়েছে। যার তুলনায় তেল বা গ্যাস আছে সামান্যই। ফলে কয়লাই চীনের শক্তি বা বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি নিরাপদ উৎস হয়ে ওঠে। খনি থেকে কয়লা উত্তোলনে বহু মানুষের চাকরি তথা কর্মসংস্থান হয়। তাই প্রয়োজন হোক বা না হোক, কয়লা প্ল্যান্ট তৈরি করা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে স্থানীয় সরকারগুলোর জন্য একটি সাধারণ উপায়।
কয়লার কথা মাথায় রেখেইচীনের পাওয়ার গ্রিড তৈরি করা হয়। যে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা পোড়ানো হয়, সেখানে মানুষই সিদ্ধান্ত নেয় কাজে নামতে হবে। কিন্তু যখন সৌর ও বায়ু শক্তির কথা আসে তখন প্রকৃতিই সর্বেসর্বা। তাই পাওয়ার গ্রিডকে আরও নমনীয় করতে হয়। যখন একটি জায়গায় শক্তির উদবৃত্ত থাকে, তখন এটি অবশ্যই সংরক্ষণ করতে বা অন্য কোথাও সরাতে সক্ষম হবে। অন্যথায় চীন ভবিষ্যতে প্রচুর নতুন বায়ু টারবাইন ও সৌর প্যানেলের সংকুলান করতে সক্ষম হবে না।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post