জনশক্তি রপ্তানিতে বড় ধরনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত যে পরিমাণ জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে তা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৯শে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ১২ লাখ ৪ হাজার কর্মী প্রবাসে চাকরি নিয়ে গেছেন। গত বছর এ সংখ্যাটি ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার।
তবে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বা জনশক্তি রপ্তানিতে রেকর্ড গড়লেও উল্টো প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। সদ্য সমাপ্ত নভেম্বর মাসেও রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও কমেছে। বিদায়ী মাসে বৈধ পথে ১৯৩ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। গত অক্টোবরের চেয়ে প্রায় ৫ কোটি ডলার কম। এ ছাড়া গত দুই অর্থবছর ধরে রেমিট্যান্স মাত্র ২২ বিলিয়ন ডলারের নিচেই স্থবির হয়ে আছে।
রিক্রুটিং এজন্সিগুলো বলছে, মহামারি করোনার কারণে দুই বছর অনেক কর্মীই বিদেশে যেতে পারেননি। পরে তারা গেছেন।
মহামারি পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে থাকায় চাকরির বাজারও উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি সব ধরনের সৌদি প্রতিষ্ঠানে অভিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য নির্ধারিত কোটা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করার ঘটনাও অবদান রেখেছে রেকর্ড এই প্রবৃদ্ধিতে।
এ ছাড়া অপ্রচলিত বাজার ইতালি এবং যুক্তরাজ্যের মতো গন্তব্যে রেকর্ডসংখ্যক কর্মী বাংলাদেশ থেকে গেছে। অবশ্য অসংখ্য কর্মী প্রধানত ওমান, সৌদি আরব এবং মালয়েশিয়ায় ভুয়া চাকরির প্রলোভনে পড়ে সঠিক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনও হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, ডলারের সংকটময় পরিস্থিতিতে এ মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস রেমিট্যান্স বাড়তে শুরু করে নভেম্বরের শুরু থেকে। ধারণা করা হচ্ছিলো মাসটিতে দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
তবে সব আশা ফিকে করে দিয়ে তা দুই বিলিয়ন ডলারের নিচেই আটকে যায়। নভেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ২১ হাজার ১৮১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা (প্রতি ডলার সমান ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা হিসেবে)। আগের মাসে এসেছিল প্রায় ১৯৮ কোটি ডলার। সে বিবেচনায় রেমিট্যান্স কমেছে ৫ কোটি ডলার। অবশ্য গত বছরের একই মাসের তুলনায় বেড়েছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল মাত্র ১৬০ কোটি ডলার।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত নভেম্বরের শুরুর দিকে ডলারের রেট বেশি ছিল। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে সংকটের মধ্যেও মার্কিন মুদ্রার দাম কমায় ব্যাংকগুলো। এতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন প্রবাসীরা। এ কারণে প্রবাসী আয় হ্রাস পেয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের অক্টোবরে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১৯৭ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। এর আগে সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স পৌঁছেছে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। আগস্টে এসেছে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
সবমিলিয়ে চলমান অর্থবছরের (জুলাই-নভেম্বর) মোট ৫ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৮৮১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১৬১ কোটি ৭ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে তা আসে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ হয়েছিল। যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০২০ সালে হুন্ডি বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলে সর্বোচ্চসংখ্যক রেমিট্যান্স এসেছিল। বিদায়ী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স। এটি এ যাবৎকালের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে করোনাকালীন ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে আমদানি ব্যাপক কমলেও আশানুরূপ রেমিট্যান্স না আসার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রচুর ডলার বিক্রি করছে ব্যাংকগুলোর কাছে। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ ছিল রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ওপরে।
রেমিট্যান্সের অসমতার কারণ হিসেবে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং ব্যাংকাররা বলেছেন, স্বল্প-দক্ষ পেশার ব্যাপকতা, অর্থ স্থানান্তরের জন্য অবৈধ চ্যানেলের ব্যবহার (হুন্ডি) এবং আর্থিক লাভের জন্য বিদেশি নিয়োগদাতার ভুয়া চাকরির প্রস্তাব এনে অদক্ষ শ্রমিকদের পাঠানো। আর বৈদেশিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো- কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় খুলে দেয়া। দেশটি উৎপাদন, নির্মাণ, পরিষেবা, কৃষি, খনি ও গৃহস্থালিসহ বিভিন্ন খাতে এ বছর ৩ লাখ ২৮ হাজার বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।
বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে সৌদি আরবের পরেই এখন মালয়েশিয়ার অবস্থান। ওদিকে এ বছর বিশেষ করে কৃষি, আতিথেয়তা এবং উৎপাদন খাতে ১৬ হাজার ২৯৭ জন বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়েছে ইতালি। যুক্তরাজ্য সেবা, গৃহকর্মী ও আতিথেয়তা খাতে রেকর্ড ৯ হাজার ৪২৭ জন নিয়োগ দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরও এ বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, করোনা পরবর্তীকালে বিদেশে গিয়েছিলেন, কিন্তু চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন শর্তাবলী পূরণ না করায় এক থেকে ১৬ মাসের মধ্যে ৩৫ শতাংশেরও বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন।
শ্রম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন,
রিক্রুটিং এজেন্সি ও বিদেশি নিয়োগদাতারা অনেক কর্মীকে মধ্যপ্রাচ্যে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে থাকে। যে কারণে এখন অন্য দেশগুলোতে অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া বেশির ভাগ শ্রমিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নির্মাণকাজ ও অন্যান্য গৃহস্থালি কাজ পেয়েছেন, তাদের বেতন কম। আবার সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনেকে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি পেয়েছেন, তাদের আরেকটু বেশি। ফলে এই অঞ্চলে বেশি শ্রমিক গেলেও রেমিট্যান্স কম আসে।
বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, আমরা একটি মাইলফলক অর্জন করেছি। কারণ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ন্যায্য চাহিদার ভিত্তিতে কর্মী পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিকের সংখ্যাও বেড়েছে। অবৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধে তিনি বলেন, হুন্ডিতে বেশি দাম পাওয়া ছাড়াও ব্যাংকিং পথে পাঠাতে তাদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। আবার বিদেশে অনথিভুক্ত অনেক কর্মী আছেন। এরা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে গিয়ে ধরা পড়ার ভয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে পারে না। তাই প্রবাসীরা যাতে ঘরে বসে সহজেই বেশি মূল্যে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে সেই উদ্যোগ নিতে হবে।
এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, জনশক্তি রপ্তানিতে মধ্যপ্রাচ্য নির্ভরতা কাটানোর চেষ্টা চলছে। এর ফলে বিকল্প শ্রমবাজার হিসেবে ইউরোপকে ভাবছে সরকার। এ ছাড়া মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকেও নজর রয়েছে সরকারের। ফলে সামনের দিনগুলোতে জনশক্তি রপ্তানি আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরেক অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছিলেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) করার চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে বৈধভাবে কর্মী পাঠানো যায়। আর এর অংশ হিসেবে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের ভাষা শেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সরকারিভাবে।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, মহামারি করোনার সময় বহু প্রবাসী দেশে ফেরত আসেন। তারা আবার গেছেন। এ কারণে জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে। তবে সেই অর্থে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়েনি। এক্ষেত্রে আমাদের দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিতে নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রণোদনার পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি। এ ছাড়া রেমিট্যান্স আনতে সিস্টেম আরও সহজ করতে হবে। তা হলে প্রবাসী আয় বাড়বে।
বিএমইটি পরিংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয় ১৯৭৬ সাল থেকে। ওই বছর ৬ হাজার ৮৭ কর্মী বিদেশে যান। তারপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়মিত জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে। দীর্ঘ ৪৮ বছরের মধ্যে শুধু ২০১৭ সালে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে আগের রেকর্ড ছিল। চলতি বছর ছাড়া ২০১৭ সালেই শুধু ১০ লাখের মাইলফলক পার করেছিল বাংলাদেশ। এ বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১২ লাখ ৪ হাজার কর্মী গেছেন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post