সংবিধানে ভোটের অধিকারের কথা থাকলেও, প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার আজও অনিশ্চিত। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি তাদের মৌলিক এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ তাদের প্রবাসীদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়, কিন্তু বাংলাদেশ তা দেয় না। ফলে প্রবাসীরা দেশে ও প্রবাসে নানা সমস্যার সম্মুখীন হন।
মোট জনসংখ্যার দিক থেকে প্রবাসীর সংখ্যা ৮ শতাংশের ওপরে। সেই হিসাবে বাংলাদেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের প্রতিটিতে গড়ে প্রায় ৫০ হাজার ভোটার প্রবাসে কর্মরত। প্রবাসীদের ভোটের অধিকার দেওয়ার গালভরা প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও তা কার্যত আলোর মুখ দেখেনি। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংসদে প্রবাসীদের জন্য সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে আসন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবাসীদের দেশের উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হলে তাদের প্রথমে ভোটের অধিকারের সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সই এখন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস।
তারা বলছেন, ভোটের অধিকার প্রদানের কার্যকর ও প্রায়োগিক উদ্যোগ কোনও সরকারই নেয়নি। পরীক্ষামূলক হলেও এবারের নির্বাচনে কয়েকটি দেশে প্রবাসীদের ভোটাধিকার শুরু করা জরুরি।
বিবিসির সূত্রমতে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশই আসে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স থেকে।
বাংলাদেশের প্রায় সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন, বৈশ্বিক মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, সর্বোপরি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে বাংলাদেশ এখনও যতটুকু টিকে আছে, তা মূলত প্রবাসীদের কল্যাণেই। রাষ্ট্র থেকে কোনও সুযোগ-সুবিধা না নিয়েও তারা নিজেদের কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন; সামষ্টিক অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখছেন। অথচ অর্থনীতির জীবনীশক্তি প্রদায়ী এসব মানুষের প্রতি রাষ্ট্র কদাচিৎ দায়িত্ব পালন করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রবাসী সরকারের তহবিল গঠন, আন্তর্জাতিক সমর্থন ও জনমত গঠনে প্রবাসীদের অবদান এবং পরে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি যাদের হাত দিয়ে তৈরি হয়েছে, সেই প্রবাসীরা সব আমলেই দেশে বঞ্চনা-লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন।
রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও প্রবাসী বিনিয়োগ বাড়াতে সব সরকার প্রয়োজনের খাতিরে প্রবাসীদের ভোটের অধিকার দেওয়ার গালভরা প্রতিশ্রুতি দিলেও আজও তা কার্যত আলোর মুখ দেখেনি। অথচ পৃথিবীর প্রায় ১২০টি দেশ তাদের প্রবাসে থাকা জনগণের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত, মালদ্বীপ ও ভুটানসহ এশিয়ার প্রায় ২০টি দেশ তাদের প্রবাসী নাগরিকদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থা করেছে।
প্রবাসীদের ভোটের অধিকারের দাবিতে যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন সময় আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন প্রবাসীরা।
গ্রেটার সিলেট কাউন্সিলের অন্যতম শীর্ষ নেতা কে এম আবু তাহের চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ১২০টি দেশ তাদের প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এর মধ্যে এশিয়ার আছে ২০টি দেশ।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার ব্যাপারে ২০০৮ সালে আইনি কাঠামো করা হয়েছিল। কিন্তু এরপর এটা নিয়ে আর কাজ করা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের এ বিষয়ে কেবল দু-একটি সেমিনার করে থেমে থাকার সুযোগ নেই।
ইউকে বাংলা প্রেসক্লাব সভাপতি রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী বলেন, প্রবাসীদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে সবার আগে। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় অনেক প্রবাসী জমি ক্রয়-বিক্রয়সহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে। তারা দেশে এসে বিভিন্ন সেবা পেতে হয়রানির শিকার হন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কনসুলার জানিয়েছেন, প্রবাসীদের সংখ্যা এখন দেড় কোটি। তারা দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখছেন।
পোস্টাল ভোট পদ্ধতিতে একজন প্রবাসী তার পছন্দমতো যেকোনও জায়গা থেকে ভোট দিতে পারেন। আবেদন করলে ওই ঠিকানায় আগে থেকে ব্যালট পেপার সরবরাহ করে নির্বাচন কমিশন। ভোট দেওয়ার পর তা ডাকযোগে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতি প্রবাসীদের জন্য ২০০৮ সাল থেকে চালু আছে। যদিও এটা সম্পর্কে মানুষ জানেন না এবং এর প্রয়োগও তেমন হয় না।
দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ভুটান, ভারত, মালদ্বীপে বিদেশে বসবাসরত নাগরিকদের ভোটের ব্যবস্থা রয়েছে। যুক্তরাজ্যে চালু রয়েছে প্রক্সি ও পোস্টাল ভোট। ১০০ বছর আগে তারা এই ব্যবস্থা চালু করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৪৯ সাল থেকে প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার প্রথা চালু আছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, কয়েক বছর আগে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা হলো। হামলাকারীদের চিহ্নিত করতেও সুবিধা হতো প্রবাসীদের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলে।
তিনি বলেন, প্রবাসী নাগরিকদের প্রবাসেই ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করা, প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের ভোটের অধিকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, সচেতনতা বৃদ্ধি ও ভোটের অধিকার প্রয়োগে উৎসাহিত করার জন্য ব্যাপক প্রচারণার ব্যবস্থা নেওয়া, ভোটের অধিকার ব্যবস্থা প্রবর্তন-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি প্রণয়ন করা যেতে পারে। বিদ্যমান আইন ও বিধি সংশোধন করে উপযুক্ত আইনি কাঠামো তৈরি করা, প্রবাসে ভোট গ্রহণের সুবিধা-অসুবিধা বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রবাসে ভোট গ্রহণের বিষয় বিবেচনা করা এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর এটিএম শামসুল হুদা কমিশন ২০০৮ সালে এবং কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০১৪ সালে দুই দফা প্রবাসীদের ভোটের অধিকার দেওয়ার বিষয়ে উদ্যোগ নেয়।
তখনকার দুই নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন ও এম সাখাওয়াত হোসাইন এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য যুক্তরাজ্য সফর করেন।
প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত ইসি ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করেছে জানিয়ে তখন ছহুল হোসাইন বলেছিলেন, এবার শুধু যুক্তরাজ্য প্রবাসীদেরই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন জটিলতার কারণে অন্যত্র করা যাচ্ছে না। তবে প্রক্রিয়া শুরু হলে পর্যায়ক্রমে সব প্রবাসীকে ভোটার করা হবে।
এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে ভোটার তালিকা আইনে সংশোধন আনে। আইন সংশোধন করে বলা হয়, কোনও বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে বসবাস করলে তিনি দেশে সর্বশেষ যে নির্বাচনি এলাকা বা ভোটার এলাকায় বসবাস করেছেন, অথবা তার নিজের বা পৈতৃক বসতবাড়ি যেখানে ছিল বা রয়েছে; তিনি সেই এলাকার অধিবাসী বলে গণ্য হবেন। পরে ২০১৪ সালে রকীব উদ্দিন কমিশনও প্রবাসীদের ভোটার করার জন্য উদ্যোগী হয়। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি।
প্রথম আলোর লন্ডন প্রতিনিধি সাইদুল ইসলাম প্রবাসীদের ভোটের অধিকারের বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আমি নির্বাচন কমিশন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দেশে অবস্থানরত শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে লিখিতভাবেও যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি প্রবাসীদের ভোটের অধিকারের বিষয় নিয়ে। ওয়ান-ইলেভেনের সেনা-সমর্থিত সরকার প্রবাসীদের ভোটের অধিকার দেওয়ার উদ্যোগ নিলেও আইনের জটিলতার কারণে তা তারা পারেনি। পরে আইন পাস হলেও গত তিনটি নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কোনও কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।
তিনি বলেন, প্রবাসীদের কাছ থেকে শুধু রেমিট্যান্স নেওয়া ছাড়া কোনও সরকারই কিছু দিতে চায় না। প্রবাসী নাগরিকদের ভোটের অধিকার প্রদানের কার্যকর ও প্রায়োগিক উদ্যোগ কোনও সরকারই নেয়নি। পরীক্ষামূলক হলেও এবারের নির্বাচনে কয়েকটি দেশে প্রবাসীদের ভোটাধিকার শুরু করা জরুরি।
উল্লেখ্য, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, প্রায় দেড় কোটির বেশি জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছেন। দ্বৈত নাগরিকের সংখ্যা ৫০ লাখ ধরলেও বাকি এক কোটি প্রবাসী জনগোষ্ঠীর সবাই প্রাপ্তবয়স্ক ও ভোটার হওয়ার উপযুক্ত এবং মোট ভোটের আনুপাতিক হারে ১০ শতাংশের বেশি। এই এক কোটি ভোটার দেশের জাতীয় নির্বাচনসহ যেকোনও নির্বাচনে ভোটের অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে ফলাফল নির্ধারণে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারতেন।
নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম সম্প্রতি বলেছেন, আইনের আলোকে পোস্টাল ব্যালটে প্রবাসীদের সবসময় ভোট দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এবারও তারা ভোট দিতে পারবেন। বিদেশে যে বাংলাদেশি মিশনগুলো রয়েছে, তার মাধ্যমে নোটিশ আকারে যেন দেওয়া হয়, সেজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বার্তা দেওয়া হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে—প্রবাসে বাংলাদেশি যারা দেশের ভোটার তালিকাভুক্ত নাগরিক রয়েছেন, তারা যদি ভোট দিতে উৎসাহিত হন, কী পদ্ধতিতে ভোট দেবেন, সে বার্তাটা যেন জানিয়ে দেওয়া হয়।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post