জীবনের গল্প পর্ব-১
জীবনের গল্প পর্ব-২
আমি মধুখালী রেল স্টেশনে বসে আছি সুনসান নীরবতা জনমানবহীন এক রেল স্টেশন। কিছুক্ষণ আগে প্রচন্ড বৃষ্টি হওয়াতে জনমানব শূন্য হয়ে পড়েছে তাই স্টেশনে কোন মানুষের দেখাই মিলছে না। আমি অনেকক্ষণ হলো দাঁড়িয়ে আছি রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে, মনে হচ্ছিল দুটি লাইন দূরে কোথাও গিয়ে একসাথে মিলে গেছে। অবাস্তব চিন্তা তার পরেও আমার চোখ দেখছে দূরে কোথাও গিয়ে লাইন দুটি মিলে গেছে!
হঠাৎ খেয়াল করলাম কে যেন আমায় পেছন থেকে ডাকছে ও-ভাই ও-ভাই দাঁড়িয়ে থেকে কোন লাভ নেই আজ আর ট্রেন আসবে না বলতে বলতে আমার পাশে এসে দাড়াল। আমি তার নাম জানতে চাইলে বলল নয়ন, নয়ন আমার নাম জানতে চাইল বললাম জীবন। নয়ন’কে দেখে মনে হচ্ছিল আমরা দুজনেই সমবয়সী।
নয়ন ভীষণ কৌতূহলী ছেলে ওর চেহারার ভিতরে অনেক মায়া আর বুকের ভেতরে কি যেন এক কষ্ট পুষে বেড়াচ্ছে ওকে দেখেই বোঝা যায়। নয়ন’কে কেন যেন খুব আপন মনে হচ্ছিল আর মনে হচ্ছিল আমরা দুজনেই একই পথের পথিক। আমার ধারনাটা ভুল হতে পারে তাই নয়নের কাছে জানতে চাইলাম। মধুখালী নয়নের মামার বাড়ি, জীবন যুদ্ধে হার না মানতে ছোটবেলায় বাবা-মাকে ছেড়ে মামার বাড়ি চলে আসে। নয়নের মামার একটা সেলুন আছে, নয়ন সেখানে মামার সাথে সেলুনে কাজ করে।
এতোটুকু বলে নয়ন থেমে বললো আমার কথা থাক অন্য আরেকদিন বলবো, তোমার কথা বল…. এরই মাঝে নয়নের সাথে আমার ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল, তাই আমি নয়ন কে সব বললাম, বললাম মধুখালী আমার পরীক্ষার সিট পড়েছে, এখানে আপন বলতে আমার কেউ নাই তাই পরীক্ষাটা দেয়া হবেনা আমার, অভাবের সংসার।
নয়ন কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমাকে ওর মামার কাছে নিয়ে গেল সেলুনে, অনেক কষ্টে ওর মামাকে বুজিয়ে রাজি করানো হলো এবং নয়নের মামার বাড়ীতে থাকার ব্যবস্থা হলো আমার। পরে আমি পরীক্ষা কালীন সময়ে নয়নের মামার বাড়ীতে থেকেই পরীক্ষা গুলো দিলাম।
এত কষ্ট করে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া টা খুব কঠিন তাই ধরে নিলাম আর পড়াশুনা হবে না আমার, কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। পাশের গ্রামের স্বপন সাহা (পাড়াতো দাদা) ফরিদপুর ন্যাশনাল ট্রেডার্সে চাকরি করে। প্রতি সপ্তাহে তাকে গিয়ে অনুরোধ করি একটি চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিতে। পরিচিত না হলে কেউ কখনো চাকরি দেয় না, তাই অনেক বার অনুরোধ করার পর তিনি বললেন আমি মালিকের সাথে কথা বলে জানাবো তোমায়।
এভাবে দুই সপ্তাহ কেটে গেল এখনো কোনো খবর পেলাম না, আমি আবার গিয়ে দেখা করলাম। উনি বললো, চিন্তা করোনা মালিকের সাথে আমার কথা হয়েছে, তিনি বেতন ধরেছে মাসে ২০০/- টাকা, মালিকের বাসায় থাকতে হবে সাথে থাকা খাওয়া ফ্রি। যাক ঈশ্বর এবার দয়া করেছ আমায়। আমি এই সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না, চাকরি নিতে রাজি হয়ে গেলাম।
চাকরিতে যোগ দিয়ে জানলাম ন্যাশনাল ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ আলী ফরিদপুর নিউ মার্কেটে সেক্রেটারি জেনারেল। ভীষণ নাম ডাক তার, সবাই ভয়ও পায় তাকে। আর আমার কাজ হচ্ছে, সকাল ৯ টার মধ্যে এসে দোকান খোলা, দোকানের ময়লা পরিষ্কার করা, ঝাড়পোঁছ দেওয়া। দোকানের ম্যানেজার অনিল বাবু ঢুকে আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন. বললাম জীবন।
অনিল বাবু নাম ধরে ডেকে এক কাপ চা আনতে বললেন আমায়, আমি চা নিয়ে আসলাম অনিল বাবুর জন্য। অনিল বাবু’কে চা দিতে দোকানে কি কি কাজ করতে হবে আমায় সব বুঝিয়ে দিলেন। দোকানে কাস্টমার এসেছে অনিল বাবু আমায় আওয়াজ দিয়ে বললেন জীবন চা নিয়ে আয় কাস্টমারের জন্য। বুকের মধ্যে ধাক্কা লেগেছে কিন্তু অবাক হইনি অনিল বাবু আমায় আগেই বলে দিয়েছিল কি কি করতে হবে আমায়, চা এনে কাস্টমারকে দিলাম।
সারাদিন দোকানে ডিউটি করে শরীর ক্লান্ত, রাতে দোকান বন্ধ করে মালিকের বাসায় চলে গেলাম। রাতের খাওয়া শেষ করে টিভি রুমে ঢুকলাম, সবাই সেখানে বসে টিভি দেখছে। যেহেতু এখনো অনেকেরই খাওয়া বাকি তাই এই সময়টা আমি টিভিরুমে মালিকের ছেলেদের সাথে টিভি দেখছিলাম। মালিকের ছেলে খাটে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে আমি তার পায়ের দিকে বসে টিভি দেখছিলাম।
হঠাৎ তার চোখ আমার দিকে পড়লো, কিরে চাকরের বাচ্চা তুই খাটে বসে টিভি দেখছিস বেরহ! গ্রামে থেকে ফরিদপুর শহরে এসেছি তাই ছোটোখাটো কোন কথাই আমার রাগ হতোনা, তবে মনে কষ্ট পেতাম অনেক, গরিবের কষ্টের মূল্য কে দিবে! তাই ভেবে চুপ করে থাকতাম।
সবার খাওয়া শেষ হলো এবার আমি ডাইনিং টেবিলটা পরিষ্কার করে তার উপর একটা কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম, কারণ এটাই আমার ঘুমানোর জায়গা, মালিক আমাকে এখানেই থাকতে দিয়েছেন, এর উপরে শুয়ে রাতে ঘুম হত না আমার। এভাবে কিছুদিন চলার পর নিজেকে আর কোনভাবে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না।
এরই মাঝে মার্কেটে অনেকের সাথেই আলাপ হয়েছে আমার কাজের সুবাদে। তাই অন্য দোকানে নতুন একটা কাজ ঠিক করলাম, সেখানে জায়গীর মাস্টার হয়ে তার বাসায় থাকব, তার বাচ্চাদের পড়াব এবং দোকানে কাজ করব, কথাবার্তা সব ঠিক হয়ে গেল। ন্যাশনাল ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ আলীকে আমি বলে দিলাম সামনের মাস থেকে আমি আর কাজ করবোনা।
কাজ করবোনা তো কি করবো.? উনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। পরের মাসে আমি এখান থেকে কাজ ছেড়ে নতুন জায়গায় কাজের জন্য চলে যাই। এ যেন বন্দীদশা থেকে মুক্তির আনন্দ নিয়ে নতুন জায়গায় কাজের জন্য রওনা, নতুন জায়গায় যাওয়ার পরে মালিক আমাকে বললেন আমি তোমাকে নিতে পারবো না।
আপনি তো জানেন আমি ওই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি এখন এই কথা বললে কি হয় বলেন? কথা না বাড়িয়ে আমি তার কাছে কারণটা জানতে চাইলাম? তার কাছে কারণটা জানলাম মার্কেটের সেক্রেটারি তাকে শাসিয়ে গেছে, সব জেনে আমি তাকে কোন দোষ দিতে পারলামনা। বুকের ভেতর স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্ট আমার চোখের জল নিয়ে এলো, আমি চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে এলাম। গন্তব্য বিহীন আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আমার মাথার উপরে মেঘলা আকাশ এই বুঝি বৃষ্টি হয়ে ঝরে ঝরে পড়বে আমার কান্নার জল মুছে দিতে…
সফলতার গল্প নিয়ে প্রবাস টাইমের এক্সক্লুসিভ নিয়মিত আয়োজন “জীবনের গল্প“
এ বিভাগে প্রতিদিন আপনাদের লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। আপনার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং সত্যিকারের সফলতার গল্প নিয়ে লেখা পাঠান। প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গল্প-কবিতা-ছড়া ও ভ্রমণ কাহিনীসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের খবরও পাঠাতে পারেন। লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেন না।
লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
https://www.youtube.com/watch?v=kleDiWrwBaM
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post