পাকিস্তানে গত বছরের এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইমরান খানকে সরিয়ে দেওয়ার পর দেশটির নাগরিকদের রাজনৈতিক মননে একটি পুনর্গঠন চেতনার জাগরণ হয়েছে, যার প্রভাব আমরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে দেখছি। দেশটিতে চলমান দ্বন্দ্বের এক মেরুতে ইমরান খান এবং অন্য মেরুতে পাকিস্তানের সেনানেতৃত্ব। এই দুই মেরুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো তাঁদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের হলরুমগুলো ও লন্ডনের মে-ফেয়ার এলাকা (যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বসবাস করছেন) থেকে শুরু করে টিকটক, টুইটার ও ইউটিউবের মতো জায়গায় নিয়ে গেছে।
এই মহা আলোড়নের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন বিশ্বনন্দিত ক্রিকেটার থেকে জনতুষ্টিবাদী নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা ইমরান খান। ২০২১ সালের শেষের দিকে সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে রদবদল নিয়ে সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লেগে যাওয়া দ্বন্দ্বের জের ধরে সেনা সমর্থন হারান ইমরান। এরপরই তিনি তাঁর নিজস্ব যোগাযোগমাধ্যমে বক্তব্য তুলে ধরে দেশে ও বিদেশে থাকা পাকিস্তানিদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, যা পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন মাত্রার অস্থিরতা তৈরি করে। তারই ধারাবাহিকতায় এখন পাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে এমন একটি রক্ষণাত্মক অবস্থান নিতে হয়েছে, যা এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে দেখা যায়নি।
সেনাবাহিনী রাজনীতিতে তাদের আধিপত্য আগের মতো ধরে রাখতে কিংবা বরাবরের মতো আধা গণতান্ত্রিক অবস্থা টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না, ইমরান খান তাদের সামনে এখন সেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। এক সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানের বিরাট অংশজুড়ে সামরিক শাসন ও জরুরি অবস্থার একটি মিশ্র অবস্থা চলছে।
সর্বশেষ ২০০৭ সালে পাকিস্তানে সেনাবাহিনী গুরুতর মিডিয়া চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। সে সময় তৎকালীন বরখাস্ত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের কঠোর আচরণ বিক্ষোভ আন্দোলনের সূচনা করেছিল। সেটি মূলত ছিল আইনজীবীদের আন্দোলন, যা পাকিস্তানের কেব্ল টিভি চ্যানেলগুলোর সহানুভূতি অর্জন করেছিল এবং বিরোধী দলগুলোও সেই আন্দোলনে পরে শামিল হয়েছিল। সংবাদ চ্যানেলগুলো সে সময় মধ্যরাতের বিক্ষোভ সমাবেশও সরাসরি সম্প্রচার করেছিল।
মোশাররফ সরকার সে সময় কিছু চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেটি তার জন্য হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরে যদিও সামরিক কর্তৃপক্ষ এই কৌশল আবার অবলম্বন করেছিল, কিন্তু তার পাশাপাশি তারা নিজেদের অনুগত চ্যানেল ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের নিয়ে একটি চক্র গড়ে তুলেছিল।
গত কয়েক বছরে পাকিস্তানের আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) দেশটির সবচেয়ে বড় মিডিয়া গ্রুপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা নিয়মিতভাবে সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করছে, প্রোপাগান্ডাধর্মী সিনেমা বানাচ্ছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে নিজেদের উপস্থিতি ধরে রেখেছে।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভারত ভুয়া খবর প্রচার করে পাকিস্তানের ওপর যে ‘পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ’ চাপিয়ে দিয়েছে, তা মোকাবিলা করতে এসব মিডিয়া তারা ব্যবহার করছে। কিন্তু পাকিস্তানের অভ্যন্তরই যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তথ্য যুদ্ধের প্রাথমিক মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা কারও অজানা নয়। ২০১৮ সাল নাগাদ সেনাবাহিনীর অনলাইন সমর্থকেরা সেই স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্য থেকে এসেছেন, যাঁরা সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ইমরান খানকেও সমর্থন করছিলেন। অনাস্থা ভোটে ইমরান অপসারিত হওয়ার পর যখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়, তখন এই ডিজিটাল স্বেচ্ছাসেবীদের বড় অংশ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরানের অনুসারী হয়ে যান।
সেনাবাহিনী তখন থেকেই তথ্যজগৎ থেকে ইমরানের প্রাধান্য আবার নিজের হাতের মুঠোয় নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সংকটের শুরুতেই সেনাবাহিনী শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে জবরদস্তিমূলক কৌশল নিয়েছে। অনেককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সমালোচনা করা সাংবাদিকদের মধ্যে যাঁরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন কেনিয়ায় রহস্যজনকভাবে খুন হয়েছেন।
যেসব চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো এখন অনলাইনে সক্রিয় আছে। অসন্তুষ্ট অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারকা হয়ে উঠেছেন। ইউটিউবে তাঁদের হাজার হাজার গ্রাহক আছে। সেনাবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী সমালোচকদের মধ্যে তাঁরাই আছেন এবং প্রায়ই তাঁরা সেনাবাহিনীর ভেতরের তথ্য তাঁদের কাছে আসছে বলে দাবি করে যাচ্ছেন। চ্যালেঞ্জটি সেনাবাহিনীর জন্য এতটাই গুরুতর হয়ে উঠেছে যে এই লোকগুলো ‘বাইরের শক্তির’ কাছ থেকে টাকা খেয়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘প্রচারণাযুদ্ধ’ চালাচ্ছে বলে সেনাবাহিনীকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে হচ্ছে। ইমরান খানের সমর্থকদের ডিজিটাল প্রচারণাকে সামাল দিতে গিয়ে সেনাবাহিনীকে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে।
দেশের ভেতরের কয়েক ডজন চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করা এক বিষয়। কিন্তু এখন পাকিস্তানে কোটি কোটি মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন এবং তাঁদের বিশাল একটি অংশ কনটেন্ট ক্রিয়েটর এবং তাঁদের নিজেদের ডিজিটাল নিউজ চ্যানেল আছে। এসব ডিজিটাল প্রচারণা মোকাবিলায় আইএসপিআরের প্রধানের সংবাদ সম্মেলনের মতো অ্যানালগ কৌশল কার্যকর হয়নি।
এখন সেনাবাহিনী জনপ্রিয় নেতা ইমরান খান আর তাঁর ডিজিটাল বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে। দুর্নীতির মামলায় ৯ মে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করার পর বিভিন্ন সেনা স্থাপনায় বিক্ষোভকারীরা তাণ্ডব চালানোয় সেনাবাহিনী নিষ্ঠুর বাহিনীর ভূমিকা নিয়েছে এবং অবৈধভাবে ইমরান সমর্থকদের তুলে নিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন তৎপরতা জারি রেখেছে। ইমরান মুক্তি পাওয়ার পর তাঁর সমর্থকেরা যেভাবে সহিংস ঘটনার জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন, তাতে সেনাবাহিনীর দিক থেকে আসা চাপের বিষয়টি স্পষ্ট করে।
পাকিস্তানি প্রবাসীরা তাঁদের জন্মভূমি পাকিস্তান এবং যেসব দেশে তাঁরা প্রবাসজীবন কাটাচ্ছেন, সেসব দেশের মধ্যে সহযোগিতার একটি নির্ভরযোগ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু সেনাবাহিনী জনগণের ওপর পীড়ন চালালে এই পাকিস্তানি প্রবাসীরা ইরানি প্রবাসীদের মতো ইরান সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় লবিং করতে থাকবেন।
পাকিস্তান সরকার তাদের নিজেদের বয়ানকে জোরালো করতে টিকটকে সমানে বিজ্ঞাপন দিয়ে পাকিস্তানিদের ‘অভব্য কাজের নিন্দা জানানোর’ অনুরোধ করেছে।
সেনাবাহিনীর দিক থেকে তরুণ পাকিস্তানিদের যে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, তা তরুণদের চুপ করিয়ে দিতে পারে বটে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সেটি সেনাবাহিনী ও বৃহত্তর সমাজের মধ্যকার ফাটলকে আরও গভীর করবে। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যর্থতা ও ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ পাকিস্তানি পেশাজীবীদের বাইরের দেশে চলে যাওয়ার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দেবে।
পাকিস্তানি প্রবাসীরা তাঁদের জন্মভূমি পাকিস্তান এবং যেসব দেশে তাঁরা প্রবাসজীবন কাটাচ্ছেন, সেসব দেশের মধ্যে সহযোগিতার একটি নির্ভরযোগ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু সেনাবাহিনী জনগণের ওপর পীড়ন চালালে এই পাকিস্তানি প্রবাসীরা ইরানি প্রবাসীদের মতো ইরান সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় লবিং করতে থাকবেন।
সর্বোপরি, পাকিস্তান এত দিন যা করে এসেছে, তা যদি তারা চালিয়ে যায়, তাহলে তাৎক্ষণিক লড়াইয়ে তারা হয়তো জিতবে, কিন্তু জনগণের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদের যুদ্ধে তাদেরই হার হবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post