বর্তমান যান্ত্রিক বিশ্বে প্রযুক্তিগত যত উন্নয়ন ও অগ্রগতি, তাতে ফুয়েল বা জ্বালানির ভূমিকা অপরিহার্য। আজকের এই আধুনিক জীবন যেমন যন্ত্র ছাড়া অবান্তর, তেমনি জ্বালানি ছাড়া যান্ত্রিক সভ্যতা অসম্ভব। গোটা বিশ্বের মোট জ্বালানি চাহিদার প্রায় আশি ভাগেরও বেশি যোগান দেয় ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম-জ্বালানি; বিশেষ করে পেট্রোলিয়াম তেল, কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ভিত্তিক জ্বালানি। বলা যায় জীবাশ্ম-জ্বালানির উপর আমরা আজ অনেকাংশে নির্ভরশীল। অন্যদিকে এই চরম নির্ভরশীলতাই আমাদের ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
গোটা বিশ্ব আজ জীবাশ্ম-জ্বালানি নির্ভরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। আর তাই, পরিবেশ রক্ষায় ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিচ্ছে ওমান। আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে রাস্তায় কমপক্ষে ২২ হাজার নতুন বৈদ্যুতিক যান নামাবে ওমান সরকার। একইসাথে ২০৫০ সালের মধ্যে সমস্ত জীবাশ্ম জ্বালানী চালিত যানবাহন প্রতিস্থাপন করা হবে। ইতিমধ্যেই ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন কমাতে এবং নেট শূন্যে পৌঁছানোর জন্য একটি বিশেষ কর্মসূচি চালু করেছে দেশটির পরিবহন, যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে মাস্কাট ডেইলির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্মসূচির আওতায় থাকছে নানা কর্মযজ্ঞ। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পরিবহন, যোগাযোগ এবং তথ্য প্রযুক্তি খাত, যা ওমানের মোট কার্বন নির্গমনের প্রায় ২০ শতাংশের জন্য দায়ী।
কর্মকর্তার মতে, মন্ত্রণালয় তিনটি পর্যায়ে শূন্য কার্বন নিরপেক্ষতার জন্য তার পরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে। প্রথম পর্যায়ে, ২০৩০ সালের মধ্যে নির্গমন তিন শতাংশ, দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০৪০ সালের মধ্যে ৩৪ শতাংশ এবং তৃতীয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ কমানোর লক্ষ্য রয়েছে।
তিনি জানান যে, প্রথম পর্যায়ে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভারী যন্ত্রপাতি থেকে ৪০ শতাংশ নির্গমন কমানোর পাশাপাশি রাস্তায় প্রায় সাত হাজার বৈদ্যুতিক যান বা নতুন হালকা যানের ৩৫ শতাংশ রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এছাড়া, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে জৈব জ্বালানি যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহার করা হবে। বন্দরগুলোতে সৌর শক্তি ব্যবহারের কাজ ইতিমধ্যেই চলছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে, মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য ২০৪০ সালের মধ্যে ২২ হাজারেরও বেশি নতুন ইভি রয়েছে, যা নতুন হালকা যানবাহনের ৬৫ শতাংশ গঠন করবে। এমটিসিআইটি পাবলিক ট্রান্সপোর্ট যানের অপারেটিং বয়স নির্ধারণের জন্যও কাজ করছে যা নির্গমন হ্রাসে অবদান রাখে এবং সবুজ জ্বালানী সরবরাহের জন্য একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এই পদক্ষেপটির ক্ষেত্রে একটি কোয়ান্টাম লিপ গঠন করবে। এমটিসিআইটি সৌর প্যানেল লাগানো বাস স্টেশন এবং বিল্ডিংগুলোতেও নির্গমন কমাতে আরও অবদান রাখতে চাইছে।
তৃতীয় পর্যায়ে, মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য শতভাগ নির্গমন কমাতে সমস্ত ট্রাক এবং ভারী সরঞ্জামগুলোতে হাইড্রোজেন বা বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে এবং ২০৫০ সালে ঘোষিত শূন্য নিরপেক্ষতা অর্জন করতে নতুন হালকা যানবাহন সবগুলোই হবে বৈদ্যুতিক।
এমটিসিআইটি অবকাঠামো উন্নত করতে এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি গ্রহণের প্রস্তুতির জন্য বেসরকারী খাতের সাথে নিবিড়ভাবে নিযুক্ত হয়েছে। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ ১৪০টিরও বেশি বৈদ্যুতিক গাড়ির চার্জার এবং ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ ৩৫০টিরও বেশি ইনস্টল করার জন্য মন্ত্রণালয় একটি স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরি করেছে।
এদিকে, সারা বিশ্বে প্রতিদিন বাড়ছে জনসংখ্যা, বাড়ছে যানবাহন আর শিল্প-কারখানা। আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জ্বালানি চাহিদা। ২০০৭ সালের এক হিসেব অনুযায়ী বিশ্বে মোট যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৮০৬ মিলিয়ন, যা ২০৩০ সালের দিকে ১.৩ বিলিয়ন এবং ২০৫০ সালের দিকে ২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। ২০০৮ সালে পেট্রোলিয়াম এবং অন্যান্য তরল জ্বালানির ব্যাবহার ছিল প্রতিদিন ৮৫.৭ মিলিয়ন ব্যারেল, যা ২০৩৫ সালের দিকে ১১২.২ মিলিয়ন ব্যারেলে পৌঁছাবে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সারা বিশ্বে সব ধরনের জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যাবহার ছিল শূন্যের কোটায়, যা ক্রমবর্ধমান ভাবে বেড়ে গত শতকের শেষ দিকে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭,৫০০ মিলিয়ন টন প্রাকৃতিক গ্যাস, ৬,০০০ মিলিয়ন টন পেট্রোলিয়াম তেল এবং ২,০০০ মিলিয়ন টন কয়লা। অন্যদিকে জীবাশ্ম-জ্বালানির সঞ্চিত ভান্ডার সীমিত ও অ-নবায়নযোগ্য, এবং ধারনা করা হচ্ছে আগামী ৪০-৫০ বছরের মধ্যে এই মজুদ নিঃশেষ হয়ে যাবে।
জীবাশ্ম-জ্বালানি ব্যবহারের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হল এই জ্বালানি পোড়ানোর ফলে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমণ এবং পরিবেশে অস্বাভাবিক ভাবে এসব গ্যাসের জমা হওয়া, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রধান কারন হিসেবে ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। এই উষ্ণতা বৃদ্ধির অনেকগুলো ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, এবং জীব বৈচিত্র্য হ্রাস অন্যতম।
গ্রিন হাউজ গ্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কার্বন-ডাই-অক্সাইড যার পরিমাণ জীবাশ্ম-জ্বালানি ব্যবহারের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিনই বাড়ছে। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত পরিবেশে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমান ছিল শুন্যের কাছাকাছি, অর্থাৎ মোট নিঃসৃত এবং ব্যবহৃত গ্যাসের মধ্যে একটি সমতা ছিল, ছিল ভারসাম্য। অথচ ক্রমবর্ধমান জীবাশ্ম-জ্বালানি ব্যবহারের ফলে ২০১২ সালে পরিবেশে এই গ্যাসের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০,০০০ মিলিয়ন টন।
তেল উৎপাদন ও বিপণনে বৈশ্বিক রাজনীতিও বর্তমানে একটি উদ্বেগের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্তুরের দশকে আরব দেশগুলোর তেল অবরোধের কারনে পুরা বিশ্বে জ্বালানি বাজার অস্থিতিশীল হয়েছিল এবং তেলের সরবরাহ মারাত্নক ভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল। অন্যদিকে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাত করে তেলের দাম কমে যাওয়ায় বর্তমানে অনেক তেল উৎপাদনকারী দেশ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে জৈব-জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যাবহারে নীতিগত ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে সৌর শক্তি, বায়ু চালিত শক্তি, জলবিদ্যুৎ, এবং ক্ষেত্রবিশেষে বায়োগ্যাসের মত বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। তাছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় সংক্রান্ত ঝুঁকি হ্রাস এবং জ্বালানি নিরাপত্তার প্রয়োজনে জীবাশ্ম-জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারের জন্য “টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১২” প্রনীত হয়েছে।
কিন্তু আমাদের দেশে গবেষণা কিংবা সরকারী নীতিতে জৈব-জ্বালানির মত সম্ভাবনাময় জ্বালানি ব্যবস্থাটি বলা যায় অনেকটা উপেক্ষিত। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধরণের জ্বালানি ব্যাবস্থার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, এবং জৈব-জ্বালানির উৎপাদন ও বিপণন আমাদের কৃষি নির্ভর অর্থনীতিকে নিঃসন্দেহে আরো গতিশীল করবে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post