বেশ কয়েক বছর আগে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ছবিটি। হৃদয় কাঁপানো, কাঁদানো ছবি। হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ছেলের লাশবাহী কফিন গ্রহণ করেছেন পিতা। বিমানবন্দর থেকে বের হতেই মুষলধারে বৃষ্টি।
কফিনের এক কোনায় আছে ছেলের ছবি। অর্থাৎ কফিনের ভেতরে কার লাশ সেটি বোঝানোর জন্য এই ছবি। বাইরের বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে ছেলের ছবি। পাঞ্জাবির নিচের অংশকে চেপে ধরে সেই ছবি বারবার মুছছেন বাবা। নিজে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছেন, কিন্তু কিছুতেই যেন ছেলের ছবিটি বৃষ্টিতে ভিজে না যায়, সেই চেষ্টাই তিনি করছেন। অথচ সেই ছেলেটিই নেই এই পৃথিবীতে।
মনে হতে পারে হঠাৎ কেন এই আলাপ? বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এই বিষয়ে একাধিক রিপোর্ট। সেখান থেকে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে ৮-১০টি করে লাশ বিমানবন্দরে আসে।
বিমানবন্দরে এই লাশগুলো গ্রহণ করেন মৃত প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যরা। বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ২০২২ সালেই বিদেশ থেকে প্রবাসী শ্রমিকের লাশ এসেছে তিন হাজার ৮৬০ জনের। ধারণা করা হচ্ছে এটিই এই পর্যন্ত এক বছরে সবচেয়ে বেশি লাশ গ্রহণের হিসাব।
তবে সামগ্রিক চিত্রের হিসাব আরও ভয়াবহ। প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত ৩১ বছরে প্রবাসীর লাশ এসেছে ৪৮ হাজার ১৩৩টি। অর্থাৎ ১৯৯৩ সাল থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত এই শ্রমিকরা লাশ হয়েই দেশে আসে।
হিসাবের সংখ্যা বাড়ে প্রতি বছরই। এই হিসাব কিন্তু শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা নয়। এটি শুধু বাংলাদেশে আসা লাশের হিসাব। এর সংখ্যা যে আরও বেশি তা না গুনেই বলা যায়।
কোভিডের সময় অনেক ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় অনেক লাশই দেশে পাঠানো যায়নি। তাই সেই সময়ে অনেককেই মৃত্যুর পর দেশে নিয়ে আসা যায়নি। তাদের দাফন করা হয়েছে বিদেশেই। এছাড়া সবাইকে যে মৃত্যুর পর দেশে আনা হয় তা নয়।
লাশ নিয়ে আসার খরচ মিটাতে না পারা, কিংবা নানা ধরনের দেনা পাওনা এবং বিভিন্ন জটিলতাসহ নানা বাস্তবতায় অনেকেরই শেষ ঠিকানা হয় প্রবাসে। মারা যাওয়া প্রবাসী শ্রমিকদের গড় বয়স ২৫ থেকে ৪০-এর মধ্যেই বেশি।
অথচ এই শ্রমিকরাই দেশের সবচেয়ে বড় রত্ন। দেশের দুঃসময়ে সবচেয়ে বেশি দেশের কাজে এসেছে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দুনিয়াকে প্রায় স্তব্ধ করে দেওয়া কোভিড-১৯-এর সময়ও অর্থাৎ ২০২০-২০২১ অর্থবছরে আমাদের দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশের অর্থনীতি চালু রাখতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিল।
২০২১-২০২২ অর্থবছরে তা কিছুটা কমে ২১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল। এর পরের বছরের হিসাবে গেলে দেখা যাবে গত বছরের শেষ ছয় মাসে বাংলাদেশ অর্জন করেছে ১০ হাজার ৪৯৩ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার।
এখন প্রশ্ন হলো, প্রতিদিনই যে আমরা প্রবাসী শ্রমিকদের এত লাশ গ্রহণ করি, এই বিষয়ে আমরা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করি? কেন এত শ্রমিক মারা যাচ্ছেন প্রবাসে গিয়ে? মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেই সবচেয়ে বেশি মৃতদেহ আসে।
মৃত্যুর কারণ হিসেবে লাশের সঙ্গে আসা ডেথ সার্টিফিকেটের বাইরে আর কিছুই জানা যায় না। তবে দেশ থেকে নিয়ে আসা ঋণের বোঝা এবং সেটি শোধ করার তাগাদা তাদের আটঘণ্টা শ্রমের বাইরে বাড়তি শ্রমের তাড়না তৈরি করে।
অতিরিক্ত পরিশ্রম হয়তো অনেক শরীর মানতে পারে না। এর বাইরে অনেক ক্ষেত্রেই থাকে মালিকের নানা ধরনের মানসিক এবং কোনও কোনও সময় শারীরিক নিপীড়ন।
এক একটি জীবন বছরের পর বছর পড়ে থাকে নতুন পরিবেশ, খরতাপের মধ্যে শুধু পরিবারের অবস্থা একটু ভালো করতে। প্রবাসী শ্রমিকের সেই ঘানিটানা জীবনে অনেক ঘরের চেহারাই হয়তো পাল্টে, কিন্তু কেউ জানতেও পারে না সেই শ্রমিকরা কেমন থাকে প্রবাসে?
শুধু মৃত্যুর খবর আর লাশ গ্রহণের সময়ই আহাজারি পড়ে। এর আগে হয়তো সেই প্রবাসীরা পরিবারকেও জানতে দেন না তার শারীরিক অবস্থা।
এখন আসি আসলে সরকারের পক্ষ থেকে কী করা হয়? আমরা জানি প্রবাসে মারা যাওয়া শ্রমিকদের মরদেহ দেশে আনতে সহযোগিতা করার কথা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের।
প্রবাসীদের সব ধরনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার কাজই তাদের। সেই হিসাবে প্রবাসী শ্রমিকদের কেউ প্রবাসে মারা গেলে দাফনের জন্য সেই পরিবারকে বিমানবন্দরে প্রবাসী কল্যাণ বোর্ড প্রথমে ৩৫ হাজার ও পরে ৩ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান দেওয়ার কথা।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী কর্মীদের পরিবারকে ২০১৮ সালে ১১৮ কোটি ৯৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছে বোর্ড। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ১০১ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
প্রবাসীরা মারা গেলে এই টাকা দেওয়া হয়, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো প্রবাসীরা প্রবাসে যাওয়ার পর মন্ত্রণালয় আসলে এই প্রবাসীদের ক্ষেত্রে কী কী দায়িত্ব পালন করেন।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)-এর গবেষণা থেকে জানা যায়, এই প্রবাসী লাশের বেশিরভাগই নারী শ্রমিকদের লাশ। ডেথ সার্টিফিকেটের বাইরে কীভাবে তিনি মারা গেলেন সেই বিষয়ে কোনও ধরনের তদন্ত করে না মন্ত্রণালয়। তাই আসলে কী ঘটেছিল সেটিও কেউ জানে না।
পরিবারকেও সেই কারণটিকেই সত্য বলে ধরে নিতে হয়। এছাড়া শ্রমিকদের প্রবাসে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় আসলে কী করে এবং কতটা খোঁজ-খবর রাখে সেই বিষয়ে শ্রমিকরা বারবার অসন্তুষ্টি জানিয়েছে।
তাই মৃত্যুর পর টাকা দিয়ে তুষ্টি না পেয়ে এই শ্রমিকদের কীভাবে বাঁচিয়ে মর্যাদার সঙ্গে প্রবাসে কাজ করতে পারে সেই বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন আট-দশটি লাশ গ্রহণ কোনোভাবেই মানার নয়। জীবনের প্রতি মনোযোগী হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন news@probashtime.com মেইলে।
![city](https://probashtime.net/storage/2024/09/city-flat.webp)
Discussion about this post