যেসব ইমারত বা স্থাপনায় মুসলমানরা একত্র হয়ে প্রাত্যহিক সালাত আদায় করেন তাই মসজিদ। মসজিদ শুধু ইবাদতের স্থান বা প্রার্থনালয় নয় মুসলমানদের বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যাবলীর প্রাণকেন্দ্র। ইসলামি শাসনামলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকান্ড মসজিদ থেকে পরিচালিত হতো। ইসলামের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বে নির্মিত হয়েছে বহু মসজিদ। পৃথিবীর সেরা মসজিদগুলোর নির্মাণশৈলী ও ইতিহাস নিয়ে মানুষের জানার আগ্রহের শেষ নেই। মুসলমানদের প্রধান উপাসনালয় মসজিদ হলেও প্রতিটি দেশের ভিন্ন সংস্কৃতির ছাপ পড়েছে মসজিদের নির্মাণশৈলীতে।
নির্মাণশৈলীতে অনন্য বিশ্বের ১০টি মসজিদ:
১. কাবা শরীফ
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদ হিসেবে পরিচিত মসজিদুল হারাম। সৌদি আরবের মক্কা নগরীর ৮৮.২ একর জায়গার উপর পবিত্র স্থান কাবাকে ঘিরে এর অবস্থান। ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র স্থান কাবা শরীফ। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই মসজিদে প্রায় ৯ লাখ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। হজের সময় মুসল্লিদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখে। সৌদি বাদশাহ আব্দুল আজিজ ১৯৫৫ সালের পর মসজিদটির অনেক সংস্কার করেন। তারপর বাদশাহ ফাহাদ পবিত্র হারাম শরীফের বাইরের দিক সংস্কারের পরিকল্পনা করেন। সেই কাজ এখনো চলছে।
২. নাসির আল-মুলক মসজিদ বা গোলাপি মসজিদ
শিরাজ, ইরান:
ইরানের প্রাচীনতম শহরে অবস্থিত নাসির আল মুলক মসজিদ, এর নান্দনিক স্থাপত্যশৈলী এবং প্রাণবন্ত শৈল্পিক রূপের জন্য বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেছে। ধর্মীয় এই প্রার্থণালয়টিকে গোলাপি মসজিদ নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। কেননা, ব্লু মসজিদের মতোই এই মসজিদের অভ্যন্তরীণ সিলিং এবং অ্যারাবেস্ক ধারার ধনুকাকৃতির খিলানগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে গোলাপি রঙের কারুকার্যমণ্ডিত টাইলস। ভোরের প্রথম আলো যখন এই মসজিদের কারুকার্যমণ্ডিত রঙিন জানালার কাচ গলে পার্সিয়ান কম্বল পাতা মেঝেতে এসে পড়ে, তখন মসজিদের অন্দরমহলে আলোআঁধারি আর রঙের এক বিভ্রম সৃষ্টি হয়। যা প্রার্থণালয়ের অলৌকিকতা এবং মাহাত্যকে আরো কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়। কাজার রাজবংশের অধিপতি মির্জা হাসান আলী নাসির আল মুলকের আদেশে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৮৭৬ সালে। এক যুগ অর্থাৎ, ১২ বছর পর ১৮৮৮ সালে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে তা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। একজন দর্শনার্থীর সংস্কৃতি বা ধর্ম যাই হোক না কেন, নাসির আল-মুলক মসজিদ বা গোলাপি মসজিদ সবসময়ই নিজের সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে সবার জন্যই উন্মুক্ত।
৩. শেখ জায়েদ গ্রান্ড মসজিদ:
বিশ্বের সেরা ১০টি মসজিদের মধ্যে অন্যতম শেখ জায়েদ গ্রান্ড মসজিদ আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে অবস্থিত। মসজিদটির নির্মাণকাল ১৯৯৬-২০০৭। আরব আমিরাতের সবচেয়ে বড় মসজিদটি ৩০ একর জায়গার উপর নির্মিত। প্রায় তিন হাজারেরও বেশি শ্রমিক মিলে তৈরি করা এই মসজিদে রয়েছে ২৭৯ ফিট উচ্চতার বিভিন্ন আকারের সাতটি গম্বুজ ও ৩৫১ ফিট উচ্চতার চারটি মিনার। মসজিদটিতে ৪১ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।
৪. সুলতান কাবুস গ্র্যান্ড মসজিদ
মাসকট, ওমান:
ওমানের রাজধানী মাসকট যাওয়ার পথে ওমান সুলতানাতের নিদর্শনস্বরূপ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুলতান কাবুস গ্র্যান্ড মসজিদ। ওমানের সবচেয়ে বড় এবং গ্র্যান্ড এই মসজিদ একদিকে যেমন ওমান সুলতানাতের ঐতিহ্য বহন করছে ঠিক তেমনই আবার নান্দনিক সোন্দর্য্যে করছে দর্শনার্থীদের বিমোহিত। সুলতান কাবুস গ্র্যান্ড মসজিদ ওমানের সবচাইতে জনপ্রিয় ও পবিত্র স্থান এবং এর রাজসিক অবকাঠামোর খ্যাতি দিগন্তজোড়া বিস্তৃত। ১৯৯২ সালে ওমানের তৎকালীন সুলতান কাবুস বিন সাইদ আল সাইদ, তার রাজত্বের ৩০ বছর উদযাপন উপলক্ষ্যে ওমানের একটি গ্র্যান্ড মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দেন। ১৯৯৪ সালে মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ২০০১ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হলে খুলে দেয়া হয় মসজিদ প্রাঙ্গণ। সুলতান কাবুস গ্র্যান্ড মসজিদের পাঁচটি মিনার মূলত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভকে নির্দেশ করে। মসজিদের নকশায় ইসলামিক আভিজাত্যের ছোঁয়া আনতে ব্যবহার করা হয়েছে কারুকার্যমণ্ডিত মোজাইক, সূক্ষ্ম স্ফটিক এবং হস্তনির্মিত আরো বিশদ কিছু। ক্ল্যাসিকাল পার্সিয়ান তাবরিজ, কাশান এবং ইসফাহান স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণও চোখে পড়ে। তবে সুলতান কাবুসের মসজিদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এর অভ্যন্তরে থাকা হাতে তৈরি বিশাল কার্পেট; যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কাটাবিহীন কার্পেট। নারীদের নামাজ পড়ার জায়গাসহ প্রায় ২৫,০০০ মানুষ একসঙ্গে এই মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারে। রয়েছে দর্শনার্থীদের ঘুরে দেখার সুযোগ।
৫. মসজিদ সালাহ মালাকা:
মালাক্কা প্রণালী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালয় উপদ্বীপ এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত একটি সংকীর্ণ সমুদ্রপ্রণালী। মালাক্কার বিখ্যাত স্থাপনার নাম মসজিদ সালাহ মালাকা। মসজিদটি সমুদ্রপাড়ে অবস্থিত। দূর থেকে দেখলে মনে হবে মসজিদটি যেন পানিতে ভাসছে। প্রাচীন স্থাপত্যের নকশার অনুকরণে মসজিদটি নির্মিত। ২০০৬ সালের ২৪ নভেম্বর মসজিদটি নামাজের জন্য খুলে দেওয়া হয়। মসজিদ সংলগ্ন বিশাল উঁচু মিনার, সুপরিসর বাগান, পার্কিং ও সামনের খোলা জায়গাজুড়ে দেখা মেলে পযর্টকদের। সুসজ্জিত মসজিদে রয়েছে নারীদের আলাদা নামাজের জায়গা। মসজিদের বিশাল কাঠের মিম্বর ও বড় সাইজের সিলিং ফ্যান এই মসজিদের বিশেষত্ব।
৬. দিল্লী জামে মসজিদ
দিল্লী, ভারত:
মোঘল স্থাপত্যশৈলী এবং ইসলামিক শিল্পকলার এক অনন্য নিদর্শন দিল্লী জামে মসজিদ। ১৬৫০ থেকে ১৬৫৬ সালে মুঘল সম্রাট শাহ জাহান কর্তৃক নির্মিত এই মসজিদ প্রাঙ্গণে একসঙ্গে প্রায় ২৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে। রয়েছে দুটি সুউচ্চ ও সুদৃশ্য মিনার; যা মসজিদের সৌন্দর্যকে আরো বৃদ্ধি করেছে। মূল প্রার্থণা কক্ষের প্রবেশপথে ফার্সি আর আরবী ক্যালিগ্রাফিগুলো মসজিদের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যকে করেছে আরো বেশি আকর্ষণীয়। লাল বেলেপাথর আর সাদা মার্বেলের সমন্বয়ে নির্মিত এই মসজিদ প্রায় ৪০০ বছর ধরে গৌরবের সাথে টিকে আছে। নামাজ ছাড়াও দর্শনার্থীদের রয়েছে ঘুরে দেখার রয়েছে সুযোগ।
৭. বাদশাহী মসজিদ:
১৬৭১-১৬৭৩ সালের মধ্যে পাকিস্তানের লাহোরে বাদশাহী মসজিদটি নির্মাণ করেন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব। সামনের বিস্তৃত চত্বরসহ মসজিদটির আয়তন প্রায় ২ লাখ ৭৬ হাজার স্কয়ারফিট। যাতে তিনটি গম্বুজ ও ১৯৬ ফিট উচ্চতার সুদৃশ্য মিনার রয়েছে। মূল ফটকে পৌছাতে মুসল্লিদের পার হতে হয় সিঁড়ির ২২টি ধাপ।
৮. তাজুল মসজিদ:
ভারতের সর্ববৃহৎ মসজিদ তাজুল মসজিদ নির্মাণ করেন মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর এর শাসনামলে নবাব শাহজাহান বেগম। যদিও তিনি এর পুরো কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। পরবর্তীতে তার মেয়ে সুলতানা জাহান বেগম নির্মাণ কাজ এগিয়ে নেন। ১৯৭১ সালে পুনরায় নির্মাণ কাজ শুরু করেন আল্লামা মুহাম্মদ ইমরান খান নদভী আজহারি ও মাওলানা সাইয়্যেদ হাসমত আলী। ১৯৮৫ সালে নির্মিত এই মসজিদে তিনটি গম্বুজ ও সুউচ্চ দুটি মিনার রয়েছে। মসজিদের বাইরে ও ভেতরে একসঙ্গে ৭৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।
৯. সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ
বন্দর সেরি বেগাওয়ান, ব্রুনাই:
ব্রুনাইয়ের রাজধানী বন্দর সেরি বেগাওয়ানে অবস্থিত সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচাইতে সুন্দর মসজিদ বলেই খ্যাত। কৃত্রিম হৃদের উপর নির্মিত হওয়ায় সোনালী গম্বুজের প্রতিচ্ছবি এক দৃষ্টিনন্দন আর মায়াকাড়া দৃশ্যের সৃষ্টি করে। কৃত্রিম হৃদের উপর ষোড়শ শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী জলযান মাহলিগাই (রাজকীয় বার্জ) এর একটি প্রতিকৃতি নির্মিত রয়েছে; যা ধর্মের পাশাপাশি সংস্কৃতিকেও ধারণ করেছে। ব্রুনাইয়ের ২৮ তম সুলতান, তৃতীয় ওমর আলী সাইফুদ্দিন এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া এই মসজিদ ব্রুনাইয়ের ইসলামিক স্থাপত্যের পাশাপাশি ইসলামিক ধারণা ও বিশ্বাসের এক প্রতিফলন। মসজিদের মূল গম্বুজটি পুরোটাই সোনায় মোড়ানো; যা এটিকে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করে তুলেছে।
১০. সুলতান আহমেদ মসজিদ বা ব্লু মসজিদ
ইস্তাম্বুল, তুরস্ক:
অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান আহমেদ প্রথমের উদ্যোগে ১৬০৯ থেকে ১৬১৬ সালের মধ্যে নির্মিত হয় সুলতান আহমেদ মসজিদ। বসফরাস প্রণালীর তীর ঘেঁষে ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ব্লু মসজিদ। হ্যাঁ, সুলতান আহমেদ মসজিদকে অনেকেই ব্লু মসজিদ বলে আখ্যা দিয়ে থাকে। নীল রঙের ইজনিক টাইলস দিয়ে অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের কাজ করা হয়েছে বলেই একে ব্লু মসজিদ বলা হয়। আবার, অনেকে বলে এর নীল রঙের গম্বুজের কারণে এটাকে ব্লু মসজিদ বলা হয়। তবে অনেকেই এই মসজিদটিকে আয়া সোফিয়া ভেবে ভুল করে থাকে। আয়া সোফিয়া ঠিক ব্লু মসজিদের উলটো দিকেই অবস্থিত। মসজিদের ছয়টি সুউচ্চ ও সুদৃশ্য মিনার রয়েছে এবং রয়েছে অলঙ্কৃত কয়েকটি গম্বুজ। যা এর সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণ করেছে। আর তাই ভোর বা সন্ধ্যার নরম আলোয় এর ছবি তোলার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে ফটোগ্রাফাররা। যদিও এটি বর্তমানে মসজিদ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়; তবে প্রার্থণার সময় ব্যতীত অন্য সময়ে দর্শনার্থীদের ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post