মিথ্যা তথ্য দিয়ে সিঙ্গাপুরে জনশক্তি পাঠানোর অভিযোগে চারটি রিক্রটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) রিপোর্ট পাঠালেও মন্ত্রণালয় নীরব ভূমিকা পালন করছে। চারটি প্রতিষ্ঠান মিথ্যা তথ্য দিয়ে গত চার বছরে প্রায় এক লাখ কর্মী সিঙ্গাপুরে পাঠিয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর সিঙ্গাপুরে নিয়োগকারী প্রতষ্ঠানের পক্ষ থেকেও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর বিএমইটি তদন্ত করেছে। অভিযোগ প্রমানিত হওয়ার পর চারটি প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়। জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করা হয়। এক মাসের বেশি সময় ধরে এটি মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।
এমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আকর্ষণীয় সিঙ্গাপুর শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। জানা গেছে, সিঙ্গাপুরে কর্মী পাঠানোর জন্য সিঙ্গাপুর ওয়েলটেক টেস্ট সেন্টার ও বাংলাদেশের গাজীপুর এয়ার ইন্টারন্যাশনাল যৌথভাবে ঢাকায় ওভারসিস ট্রেনিং ও টেস্টিং সেন্টার (ওটিসি) স্থাপন করে কয়েক বছর আগে। গাজীপুর এয়ার ইন্টারন্যাশনাল ছাড়াও আল জান্নাত ওভারসিজ প্রা. লি., আর এক্স কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল এবং ওয়েলটেক এমপ্লয়েমেন্ট সার্ভিসেস নামে প্রতিষ্ঠানগুলো এই ট্রেনিং ও টেস্টিং সেন্টারের মাধ্যমে কর্মী পাঠিয়েছে।
এধরনের সেন্টার স্থাপনের জন্য সিঙ্গাপুর বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অথরিটি (বিসিএ) এবং বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন ও লাইসেন্স নিতে হয়। ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুর বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অথরিটি নানা অনিয়মের অভিযোগে সিঙ্গাপুর ওয়েলটেক টেস্টিং সেন্টারের লাইসেন্স বাতিল করে দেয়। বিষয়টি গোপন রেখে গাজীপুর এয়ার ইন্টারন্যাশনালসহ চারটি প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর ওয়েলটেক টেষ্ট সেন্টারের নামে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিএমইটিতে মিথ্যা চিঠি জমা দিয়েছে। মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতেই তাদের লাইসেন্স নাবায়ন হয়েছে এবং তারা কর্মী পাঠিয়েছে সিঙ্গাপুরে। গণমাধ্যমে এই তথ্য প্রকাশিত হবার পর বিএমইটি তদন্ত শুরু করে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিএমইটি গত ৮ নভেম্বর চারটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি পাঠায়। চারটি প্রতিষ্ঠান সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় গত ১৭ নভেম্বর বিএমইটি মন্ত্রণালয়ের কাছে রিপোর্ট পাঠায়।
বিএমইটি থেকে মন্ত্রনালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য যাচাইয়ে বিএমইটির সার্ভার থেকে চারটি রিক্রুটিং এজেন্সি কর্তৃক এসও হিসাবে সিঙ্গাপুরে বহির্গমনের ছাত্রপত্র গ্রহণের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ইতোমধ্যে চারটি এজেন্সির জবাব পাওয়া গেছে। তাদের বক্তব্য এবং সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, মন্ত্রণালয়ের ২১/১২/২০২১ তারিখে ৩০১ নম্বর স্মারকে ওয়েলটেক কনস্ট্রাকশন প্রা. লি. ১৬২ রেসকোর্স রোড সিঙ্গাপুরকে এনওসি হোল্ডার এবং পার্টনারদের জন্য ওটিসি হিসাবে ৩১/১২/২০২২ পর্যন্ত নবায়ন করা হয়েছে। চারটি এজেন্সি মন্ত্রণালয় কর্তৃক উক্ত টেস্টিং সেন্টারের সঙ্গে এনওসি হোল্ডার ও পার্টনার হিসেবে সংযুক্ত এবং সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণে জন্য এসও হিসেবে অনুমোদিত।
তবে সিঙ্গাপুরের বিল্ডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন অথোরিটির (বিসিএ) ওয়েবসাইটে বিসিএ অনুমোদিত সেস্টিং সেন্টারের তালিকায় ওয়েলটেক অন্তর্ভুক্ত নয়। বর্ণিত প্রেক্ষাপট বিবেচনায় চারটি রিক্রটিং এজেন্সি অসাধু উপায়ে তথ্য গোপন করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণায় থেকে ওটিসি ও এসও নাবায়ন করেছে। এটি বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন ২০১৩ এর লঙ্ঘন বিধায় ওয়েলটেক কনস্ট্রাকশন লি. সিঙ্গাপুর এবং উপরোক্ত চারটি এজেন্সির কার্যক্রম চলমান রাখা এবং পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গহণের জন্য আনুষঙ্গিক কাগজপত্র পাঠানো হলো।’ গত এক মাসের বেশি সময়েও মন্ত্রণালয় থেকে কোন নির্দেশ বিএমইটিতে পাঠনো হয়নি।
এ ব্যপারে গাজীপুর এয়ার ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী ফেরদৌস আহমেদ বাদলের কাছে জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান বিগত বিশ বছরে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর জন্য কমপক্ষে ৩০ হাজার দক্ষ শ্রমিক তৈরি করেছে। আমরা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছি। তারপরও কিভাবে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিএমইটি চিঠি দিতে পারে।’ তিনি দাবি করেন ৫ ডিসেম্বর হাজির হওয়ার জন্য তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল ২৯ নভেম্বর। এই চিঠির ইস্যুর ১২ দিন আগেই বিএমইটি কীভাবে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিতে পারে। সিঙ্গাপুর ওয়েলটেক টেস্ট সেন্টারের লাইসেন্স বাতিল সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা যে ক্যাটাগরিতে লোক পাঠাই তাতে ওয়েলটেকের রেজিষ্ট্রেশান প্রয়োজন হয় না। আমরা নিউ স্কিলড টেস্ট করি না। তারপরও চ্যালেঞ্জ করে বলতে চাই সেখানকার বিসিএ-এর ওয়েবসাইটে ওয়েলটেকের নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে। আমাদের কাছে সব ধরনের ডকুমেন্টস রয়েছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে সচিব ড. আহমেদ মুনিরুস সালেহীন বলেন, এটা আমার জন্য বিব্রতকর। আমি এ নিয়ে কথা বলতে চাইনা। জানতে চাইলে বিএমইটির মহাপরিচালক শহীদুল আলম বলেন, মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে এসব তদন্ত করা হয়েছে। অনিয়মের কথা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পরই মন্ত্রনায় তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরের বিসিএ ওয়েবসাইটে অনুমোদিত সেস্টিং সেন্টারের তালিকায় ওয়েলটেকের নাম নেই। অভিযুক্তদের শুনানি না নেওয়ার আগেই আপনার দপ্তর থেকে কিভাবে ২০১৩ সালের আইনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য মন্ত্রনালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা আমার জানা নেই, দেখতে হবে।
বিএমইটির রিপোর্ট খুবই স্পষ্ট। অভিযুক্ত এজেন্সিও তাদেরকে নির্দোষ বলে দাবি করছেন। এমন প্রেক্ষাপটে মন্ত্রনালয়কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তদন্তের স্বার্থে গাজীপুর এয়ার ইন্টারনেশনালের কাছে মন্ত্রণালয় সিঙ্গাপুরের বিসিএ প্রতি বছর ওয়েলটেক সেন্টারকে যে এনওসি দিয়েছে তার কপি চাইতে পারে। গাজীপুর এয়ার তাদের এনওসি নবায়নের জন্য ওয়েলটেকের কাছে যেসব চিঠি দিয়েছে তার কপি চাইতে পারে। সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়োগের জন্য ওয়েলটেকেরে লাইসেন্স বলবৎ রয়েছে কিনা বিসিএর কাছে তাও জানতে পারে। এগুলো জানতে খুব একটা সময়ের প্রয়োজন নেই। মন্ত্রণালয় যে পথেই হাটুক দ্রুত সিদ্ধান্ত দেওয়া জরুরি। যদি চারটি কোম্পানী নির্দোষ হয় তবে তাদের লাইসেন্স নবায়ন করা হোক। যদি তারা অপরাধ করে থাকে তবে আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হোক। মনে রাখতে হবে, সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের জন্য একটি আকর্ষণীয় শ্রমবাজার। বর্তমানে দেশটিতে ১ লাাখেরও বেশি বাংলাদেশী কর্মী কাজ করছে। দেশটিতে কর্মীরা ভালো বেতনও পান। এমন একটি শ্রমবাজার যাতে কারও স্বার্থের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে সবাইকে সতর্ক হতে হবে বলে মনে করছেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post