বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় দুবাই থেকে ঢাকা ফিরেন প্রবাসী হাসান মাহমুদ। বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষায় তার স্বজনরা। দীর্ঘদিন পর সাক্ষাৎ হচ্ছে- এই আনন্দ সবার চোখে-মুখে। নির্ধারিত সময়ে বিমান অবতরণ করলেও হাসান মাহমুদ বের হচ্ছে না দেখে স্বজনদের মধ্যে বইছে অস্থিরতা। সকাল ১১টার দিকে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাইরে আসেন এই প্রবাসী। স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই বিমানবন্দরের কেনোপি হলে অপেক্ষায় থাকা হাসান মাহমুদ ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, লাগেজ খুঁজে পাওয়া, পরীক্ষা, ইমিগ্রেশন পার হতে তার প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লেগেছে। ইমিগ্রেশনে নানা অবান্তর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। শরীরে থাকা পোশাক, বেল্ট ও জুতা খুলে তল্লাশি করা হয়েছে। হাসান মাহমুদ বলেন, এয়ারপোর্টে স্ক্যান করা নিয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বাড়িতে যারা থাকেন তাদের জন্য তো কিছু জিনিসপত্র আনতে হয়- এটাই স্বাভাবিক।
এখানে দায়িত্বরতদের আচরণ অনেক খারাপ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে গিয়েছি সেখানে এয়ারপোর্টগুলোতে এমন বিড়ম্বনা পোহাতে হয় না। শুধু হাসান মাহমুদই নন ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশে আসা প্রবাসীদের এমন ভোগান্তি এখন নিত্যদিনের। সরজমিন বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থান করে প্রবাসীদের এই দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে।
হাসান মাহমুদ বলেন, দুবাই থেকে ৫০ কেজি ওজনের মালামাল আনতে পারি। সেখানে নিয়ে এসেছি বিশ কেজি। এয়ারপোর্টে আসার পর আমার লাগেজ পাঁচবার খোলা হয়েছে। অনেক সময় দাঁড় করে রাখা হয়েছে। লাগেজ স্ক্যানে দিয়েছে, বেল্ট খুলছে, মানিব্যাগ, জুতা দেখছে, ল্যাপটপ, মোবাইল সব পরীক্ষা হয়েছে। বাইরের দেশে সব স্ক্যানে দিলেই কাজ শেষ। সেখানে কোনো লাগেজ বা শরীরের কোনো কিছু খোলে না। আমি তো বেআইনি কিছু আনছি না, তাহলে আমাকে কেন এই ধরনের হয়রানির শিকার হতে হবে? আমাদের কী কোনো সম্মান নেই।
যাত্রীরা ভোগান্তির অভিযোগ করলেও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছেন, স্বাভাবিক নিয়মেই সব হচ্ছে। আগে তৃতীয় টার্মিনালের কাজের কারণে কিছু সমস্যা ছিল এটি এখন কমে এসেছে। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, বিমান নামার এক ঘণ্টার মধ্যে ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ লাগেজ সরবরাহ করে দিচ্ছি। লাগেজ পেতে এখন কোনো সংকট হচ্ছে না।
অন্যান্য প্রক্রিয়াও স্বাভাবিক নিয়মে হচ্ছে। বিমানবন্দরে যাত্রীদের অভিযোগ অনেক সময় লাগেজ নিতে ট্রলি পাওয়া যায় না। এ ছাড়া কেনোপি থেকে ট্রলি বাইরে নেয়া যায় না বলে লাগেজ টেনে বা মাথায় করে নিয়ে যেতে হয়। এ ছাড়া যেসব স্বজন প্রবাসীদের গ্রহণ করতে আসেন তাদেরও নানা কষ্ট পোহাতে হয় বাইরে দাঁড়িয়ে। অপেক্ষমাণদের জন্য বসার সুব্যবস্থা না থাকায় রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে তাদের অপেক্ষা করতে হয়।
কেনোপিতে দাঁড়িয়ে বাইরে বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন কুয়েত প্রবাসী ইসরাফিল। তিনি বলেন, আমি এ পর্যন্ত ৫ বার দেশে এসেছি। আমার সঙ্গে মালামাল এনেছি অল্প। আধাঘণ্টা অপেক্ষার পর আমি একটা ট্রলি পেয়েছি। এরপর জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি। আমাদের প্রবাসীদের কষ্ট বোঝার কেউ নেই। এই ট্রলির ব্যবস্থাটা আরও নিয়মের মধ্যে আনা উচিত। আমরা যেন আসার সঙ্গে সঙ্গে ট্রলি হাতে পেয়ে যাই। সবসময় দেখি যাত্রীদের সঙ্গে অনেক সমস্যা হয়। যাত্রীরা ঠিক মতো ট্রলি পাচ্ছে না, জিনিসপত্র একটা পাচ্ছে তো আরেকটা পাচ্ছে না। কখনো কখনো ব্রিফকেস ছুড়ে মারছে। ভেঙে যাচ্ছে। প্রবাসীদের তো এগুলো কষ্ট করে আনতে হয়। বিদেশ থেকে এই এয়ারপোর্টে আসলে জিনিসপত্রগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। এদিকে ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট চেক হওয়ার পর বাইরে আরও কয়েকবার চেকের শিকার হতে হয়েছে আল-আমিনকে। তিনি সৌদি আরব থেকে এসেছেন। আল-আমিন বলেন, লাগেজের জন্য একঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম।
একটা ট্রলি আনার জন্য আমাকে বিশ মিনিট হাঁটতে হয়েছে। এখানে তিন থেকে চার বার চেক করে। পাসপোর্ট ইমিগ্রেশনে একবার চেক হওয়ার পর আরেক জন চেক করছে। এটা বড় ধরনের একটা হয়রানি। ইমিগ্রেশনের দায়িত্বে যে পুলিশ আছেন তিনি তো চেক করছেন। এরপর বাইরে থাকা পুলিশের কনস্টেবল তারাও পাসপোর্ট চেক করছে। কিন্তু সৌদিতে প্রবেশের সময় পাসপোর্ট একবারই চেক করা হয়। সেখানে কোনো ধরনের হয়রানি নেই। এয়ারপোর্টে ট্রলি সার্ভিসটা যদি একটু ভালো থাকতো তাহলে আমাদের এত দূরে গিয়ে আনতে হতো না। ছয় বছর ধরে বিদেশে থাকি। বিদেশের এয়ারপোর্টে ঝামেলা না করলেও দেশে এসে প্রতিবার এমন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বাবাকে বিমানবন্দরে এগিয়ে দিতে এসেছিলেন নাঈমুল হাসান। টার্মিনালের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে কয়েকটি চেয়ার দিয়ে বসার ব্যবস্থা থাকলেও রোদে পুড়তে হচ্ছে তাকে।
এদিকে বয়স্ক বাবাকে বিদায় না জানিয়েও ফিরতে পারছেন না। নাঈমুল হাসান বলেন, বাবা সৌদি আরব যাচ্ছেন। এই যে এয়ারপোর্টের টার্মিনাল এখানে বসার কোনো সুব্যবস্থা নেই। চার ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। ব্যবস্থা থাকলেও রোদে পুড়তে ও বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। প্রত্যেকটি যাত্রী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে আসা লোক রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, কষ্ট করছে। তিনি বলেন, এই রোদের মধ্যে কয়েকটি চেয়ার ফেলে রাখা হয়েছে। মানুষ এখানে কীভাবে বসবে। উপরে নেই কোনো ছাউনি। সবাই গরমের মধ্যে চেয়ারে না বসে ময়লার মধ্যে বসে আছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে বিমানবন্দরে দর্শনার্থী বন্ধ করে দেয়া হয়। এর আগে যাত্রীর সঙ্গে যাওয়া দর্শনার্থীরা ফি দিয়ে বিমানবন্দরের ভেতরে বসার সুযোগ পেতেন। এ সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হলেও দর্শণার্থীদের জন্য বাইরে বসার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। স্বজনের অপেক্ষায় থাকা সোলাইমান হোসেন বলেন, বাইরে বসার পরিবেশ করে দিলেও কেউ তো বসছে না। উপরে কোনো ছাউনি নেই। বৃষ্টি এবং রোদে মানুষকে পুড়তে হয়। সেক্ষেত্রে প্রবাসীদের যতটুকু সুযোগ-সুবিধা দেয়া প্রয়োজন তা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। আমাদের পরিবারগুলোরও কোনো সুযোগ নেই।
আমার বাবা বাইরে থাকেন। আজ খালুকে নিতে এসেছি। প্রতিবার যখন এই এয়ারপোর্টে আসি তখন ভোগান্তি পোহাতে হয়। ট্রলি নিয়ে বাইরে যেতে দেয় না। ভারী জিনিসপত্রগুলো মাথায় করে বহন করতে হয়। ‘এতগুলো ব্যাগ কীভাবে বাইরে নিবো। এখানে স্বজনদের কাউকে ঢুকতেও দেয় না। ব্যাগ রেখে ট্রলি আনতে গেলেও তো ভয় হয়। যদি চুরি হয়ে যায়। বিদেশে বিমানবন্দরগুলোতে গাড়ি পর্যন্ত ট্রলি নিয়ে অনায়াসে যাওয়া যায়।’ এভাবে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন রাসেল। তিনি কুয়েত থেকে এসেছেন। রাসেল বলেন, ২২ বছর ধরে কুয়েতে থাকি। ভেতরে আসলে লাগেজগুলো পেতে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। যারা কাউন্টারে তাদের লোকজন কম আছে। এই তিনঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কুয়েতের এয়ারপোর্ট অনেক ভালো। আমরা সেখানে কাউন্টারে গেলেই ছেড়ে দেয়। আর এখানে চেকপোস্ট থেকে শুরু করে পাসপোর্ট কয়েকবার চেক হয়। যাত্রীসেবা দেয়ার জন্য আরও লোক বাড়ানো দরকার। আমরা বাইরে থেকে অনেক ক্লান্ত হয়ে দেশে আসি। পরিবারের লোকদের নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। বসার জায়গা নেই। এয়ারপোর্টে অনেকে নতুন আসে তাদের কোনো ধারণা থাকে না।
প্রবাসীরা কোথায় যাবে, কোনদিকে যাবে। এই সহযোগিতা করার জন্য কোনো লোক নেই। এখানে রাতে আসলে মশারও অনেক সমস্যা আছে। কুয়েত থেকে ফিরেছেন মিঠুন। তিনি বলেন, প্লেন থেকে নামার পর সারা শরীর চেক করেছে। এরপর কাউন্টারে ঢুকলে টিকিট দেখাও, পাসপোর্ট দেখাও এসব অনেক ঝামেলা। কুয়েত থেকে চারবছর পর দেশে এসেছি। ইমিগ্রেশন হতে আধাঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। তবে আগের চেয়ে মোটামুটি সময় কম লাগছে। আরও চেঞ্জ হওয়া দরকার। ট্রলি নিয়ে অনেক সমস্যা। ট্রলি নিয়ে বাইরে যেতে দেয় না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। গাড়ি আসতেও অনেক সময় লাগে। দীর্ঘ ভ্রমণ করে এসে ভারী জিনিসপত্র মাথায় নিয়ে গাড়ির কাছে যেতে হয়। তিনি আরও বলেন, বাইরের এয়ারপোর্টে আমাদের কোনো হয়রানি করা হয় না। দেশের এয়ারপোর্টে আসলে অনেক কিছু ও অনেক কথা বলতে হয়। কোন জায়গা থেকে এসেছি, কীভাবে এসেছি, কী কী নিয়ে এসেছি ইত্যাদি। তাদের অন্য দেশের মতো হওয়া উচিত। অন্য দেশে তো এয়ারপোর্টগুলোতে অনেক সেবা দেন আমাদের। কোথায়, কোনদিকে যাবো সেসব বলে দিচ্ছেন। কিন্তু এখানে আসলে তার চিত্র বদলে যায়। এখানকার বিমানবন্দরে সেবার মানটা আরও বাড়ানো উচিত।
সূত্র: মানবজমিন
আরো পড়ুন:
ছুটিতে দেশে এসে সৌদি প্রবাসীর মৃত্যু
বেড়েছে প্রবাসী আয়, রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন ডলার
হুন্ডিতে টাকা নিলে বিপদে পড়বেন প্রবাসীর স্বজন
মৃত্যুকূপ পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পৌঁছেছে ৩৮ বাংলাদেশি
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post