হাসপাতালের বিছানা থেকে বলছি, দয়া করে শুনবেন কি মানুষ !!?
আমি এক তাগড়া যুবক, বয়স-২৭, নিরোগ, তরতাজা। ভেবেছিলাম, এই করোনাভাইরাস ঘটিত মহামারি আমার রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাঙতে পারবে না। ষোলো দিন আগে, জ্বর হলো আমার; সাধারণ ফ্লু ভেবে চুপচাপ কাটিয়ে দিলাম দিনটা। পনেরো দিন আগে, শরীর ব্যথা; জ্বর কমে, বাড়ে; পেইনকিলার খেলাম দু’টো।
চৌদ্দ দিন আগে জ্বর আসে যায়, শরীর ব্যথা বাড়ে তো বাড়েই, সিজন চেঞ্জ হচ্ছে, আমি ফ্লুতেই থাকলাম, আমি পেইনকিলারেই থাকলাম। তেরো দিন আগে, সারাদেহে ব্যথা কমলো, এলো গলা ব্যথা। বারো দিন আগে, খুশখুশে কাশি, গলা ব্যথা বাড়ে, কমে; জ্বর ছিলো; আশঙ্কিত আমি ডায়াগনোসিসে গেলাম। এগারো দিন আগের ভোরে, জানলাম, আমি কোভিড-১৯ পজিটিভ; স্বাদ ও ঘ্রাণ এই দুই ইন্দ্রিয় ক্ষমতা হারাতে আরম্ভ করলো।
দশ দিন আগে, দু’কানের ভিতরে তীক্ষ্ণ ব্যথা। স্বাদ নেই, গন্ধ নেই, ব্যথা গলায়, কাশি, জ্বর দেহে। নবম দিন থেকে, বাকি সব উপসর্গের সাথে আরম্ভ হলো শ্বাসকষ্ট। অষ্টম, সপ্তম, ষষ্ঠ দিন গেলো; সে কী প্রাণপণ চেষ্টা আমার, একটু বাতাস নিতে বুকের ভিতরে! হায়, এ-জগতে একমুঠো হাওয়া কি নাই!??
আজ থেকে ছয় দিন আগে ঘর থেকে বের করা হয়েছিলো আমাকে। পুলিশ ছিলো দু’জন, দু’জন স্বাস্থ্যকর্মী ছিলো, ছিলো একটি অ্যাম্ব্যুলেন্স। আমার মাকে উঠতে দেওয়া হয়নি অ্যাম্বুলেন্সে, আমার বাবাকে আসতে দেওয়া হয়নি আমার সাথে, আমার ভাইকে আটকে দেওয়া হয়েছে ঘরের দুয়ারেই, আমার বোন তখন অজ্ঞান আমার শোকে।
অ্যাম্বুলেন্স চলে আসছিলো তার প্রিয় সাইরেন বাজিয়ে; ভেতরে চিৎ শোওয়া আমি, একটু শ্বাসের খোঁজে আথালি পাথালি আমি, মাথাটা একটু তুলে আমার দু’পায়ের ফাঁক গলে, অ্যাম্বুলেন্সের দরজার ছোট্ট জানালা দিয়ে দেখেছিলাম! আমার বিদায়পথের দিকে অপলক তাকিয়ে ধুলায় শুয়ে আছেন আমার মা, দু’হাতে মাথাটা চেপে দু’হাঁটু ধুলায় গেঁথে অবিশ্বাসে তাকিয়ে আছেন আমার বাবা।
আমার বোন তখন ঘরের মেঝে অচেতন। আমি শেষ দেখা দেখেছিলাম আজন্ম প্রিয়তম মানুষগুলোকে আমার। আজ ছয়দিন, হাসপাতালের আইসিইউ-কক্ষের ভিতরে, শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছি আমি; ওষুধ নেই এই জগতে এ ব্যাধির; এই যে ছয়-ছয়টা দিন বেঁচে ছিলাম, রোগপ্রতিরোধী পথ্য খেয়ে, যদি মিরাকল হয়, যদি সেরে ওঠে পরাজিত দেহটা আমার! হাজারে-হাজারে তো এভাবেই ফিরে যেতে পেরেছে মায়ের কোলে, বাবার বুকে!
আজ ডাক্তারের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে অসুবিধে হয়নি আমি মারা যাচ্ছি। নার্সের চোখে আমি জল দেখেছি গতকাল, জেনেছি এই জন্মভূমি, এই পৃথিবী, আমার মায়ের বুক, আর আমার নয়! এখন আমি মারা যাচ্ছি। জানি, আমার লাশটাকে ছুঁতে দেওয়া হবে না আমার পরিজনদের কাউকেই, জানি, আমাকে দাহ করা হবে পাঁচজন পুলিশের সামনে।
জানি, আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে চারজন অনাত্মীয়ের কাঁধে চড়ে; মা নিষিদ্ধ, বাবা নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ আমার ভাই ও বোন, আমার কাছে, আমার লাশেরও কাছে। আমি সুস্থ, সবল যুবক ছিলাম এক, বয়স-২৭, আজ করোনাভাইরাসের কাছে হেরে যাওয়া, কাবু। পৃথিবীতে বেঁচে থাকা প্রিয় মানুষেরা, হাসপাতালের বিছানা থেকে বলছি, দয়া করে শুনবেন প্লিজ?
আরও পড়ুনঃ ওমানের সিবে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা
আজ থেকে সতেরো দিন আগে মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলাম আমি। জানিনি না, আমার দেহতে বয়ে নেওয়া এ-মারণব্যাধি আমার মা, বাবা, ভাই কিংবা বোনের দেহে সংক্রমণ করে দিয়ে মরে যাচ্ছি কিনা। মানুষ, ঘরে থাকবেন প্লিজ। এ মৃত্যু, জগতের নির্মমতম মৃত্যু।।
ঘরে থাকি সুস্থ থাকি পরিবারকে সুস্থ রাখি। সংগ্রহীত
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post