দীর্ঘ তিন বৎসর পর বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে পুনরায় শ্রমিক প্রেরণের সমঝোতা স্বারক সাক্ষরের পর শুরু হয় সিন্ডিকেট বিষয়ে নানা প্রকারের জটিলতা। মালয়েশিয়ান মন্ত্রী মহোদয়ের ২৫ টি লাইসেন্সের মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর প্রস্তাবের জবাবে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী মহোদয় সমঝোতা স্বারক (MOU) অনুসরণ করা অথবা সকল লাইসেন্স সমঅধিকার অথবা বাংলাদেশের আইনের (Compitition Act) কথা উল্লেখ করে JWC মিটিং এর প্রস্তাব দেন।
এরপর গত কয়েক দিন পূর্বেও বাংলাদেশ দূতাবাস, রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাই পদ্ধতি অনলাইন ও স্বয়ংক্রিয় করা এবং দুই দেশের অনলাইন পদ্ধতি যুক্ত করা বিষয়ে JWC মিটিং এর প্রস্তাব দেন। কিন্তু এই বিষয়ে এখনো কোন জবাব আসেনি মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ থেকে।
“মালয়েশিয়ায় আমরা কর্মী পাঠাতে চাই, তবে সেটা যে কোনো মূল্যে নয়, আত্মমর্যাদা বিসর্জন ও দেশকে বিকিয়ে দিয়ে নয়”
সুতরাং এতে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার গাফিলতি নেই। আমাদের মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সঠিক ভাবে এগোচ্ছেন। যারা বলার চেষ্টা করছেন তিনি কর্মী পাঠাতে প্রস্তুত নয় অথবা কোন সিস্টেম নেই, তারা বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন। আমি প্রবাসী অ্যাপ এর মাধ্যমে ইতিমধ্যেই লক্ষ লক্ষ বিদেশগামীদের কোভিড ১৯ টিকা সুচারু ভাবে দেয়া সম্ভব হয়েছে।
ইতিমধ্যে সেই অ্যাপকে আরও আপডেট করে রিক্রুটমেন্ট সিস্টেম কর্মী বান্ধব করা হয়েছে ও হচ্ছে। অনেকে আবার মন্ত্রী মহোদয়কে চাপে রাখার জন্য বলার চেষ্টা করছেন, বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিতে দেরী করলে মালয়েশিয়া অন্য দেশ থেকে কর্মী নেবে বা নেয়ার জন্য আলাপ আলোচনা করছে। কিন্তু মজার ব্যপার হলো, বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশ থেকে কী মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো নিষেধ ছিল? সব দেশই খোলা আছে। কিন্তু অনেক দেশই বিভিন্ন কারণে কর্মী পাঠায়নি বা পাঠায়না।
মালয়েশিয়া চাইলে অন্য দেশ থেকে কর্মী আনবে এটাই স্বাভাবিক এবং কোভিড সময় ছাড়া সবসময় নিয়েছে কিন্তু পুরোপুরি চাহিদা মেটাতে পারেনি। সুতরাং বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া ছাড়া তাদের পরিপূর্ণ চাহিদা মেটানোর কোনো সুবিধাজনক দেশ আপাতত নেই। যাই হোক, আমরা আশা করছি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় তার চিঠিতে যা লিখেছেন সেভাবেই এগিয়ে যাবেন।
সেক্টরের অভিভাবক হিসেবে তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিশেষ কোন লাইসেন্সকে বিশেষ সুবিধা না দিয়ে দেশ ও কর্মীর স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সকল বৈধ রিক্রুটিং লাইসেন্সের স্বার্থ ও রক্ষা করবেন। সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি উনার উপর সেই আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে বদ্ধপরিকর।
ডাম্পিং গ্রাউন্ড :
মালয়েশিয়ান মানব সম্পদ মন্ত্রী-মহোদয় বরাবরই বলছেন প্রতিটি দেশের কয়েক হাজার রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি আছে, সবাইকে কর্মী পাঠানোর সুযোগ দিয়ে তিনি তার দেশকে ডাম্পিং গ্রাউন্ড করতে চান না। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক! কারণ মানুষকে দিয়ে কখনো ডাম্পিং গ্রাউন্ড হতে পারে না। এটা অমানবিক কথা।
আমাদের জানার ইচ্ছে:
প্রথমত: ১৪ টি দেশের মধ্যে তিনি আর কোন দেশে রিক্রুটিং এজেন্সির লিমিটেশন করেছেন? তিনি কি তাঁর নিজের দেশের রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিকে লিমিটেশন করতে পেরেছেন?
দ্বিতীয়ত : তিনি হয়তো ২০৭-৮ সালে বাংলাদেশী বেশকিছু সংখ্যক কর্মীদের চাকুরী, বেতন ও বিভিন্ন সমস্যার সূত্রধরে এই কথা বলছেন। কিন্তু ঐ সময় কি বাংলাদেশের একজন কর্মীও মালয়েশিয়ান সরকারের এপ্রুভাল, কলিং ভিসা, বাংলাদেশ দূতাবাসের সত্যায়ন ও বিএমইটির অনুমোদন ছাড়া গিয়েছে? কখনো যায়নি এবং যাওয়া সম্ভবও নয়।
সুতরাং যে অব্যবস্থাপনা হয়েছে, সেটার জন্য সম্পূর্ণ ভাবে মালয়েশিয়া দায়ী। মোটেই বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি নয়। বরং সেদেশের আউটসোর্সিং কোম্পানি গুলোই বেশি দায়ী।
তাছাড়া প্রযুক্তির এই যুগে ১৩/১৪ বৎসর আগের রিক্রুটমেন্ট আর এখনকার রিক্রুটমেন্ট সিস্টেম কোনো ভাবেই এক হওয়ার সুযোগ নেই। তখন কোনো অনলাইন পদ্ধতি ব্যবহার হতোনা এখন সম্পূর্ণ অনলাইন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
মানব সম্পদ মন্ত্রী মহোদয় আরও বলেছেন “কম সংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সি হলে তিনি কন্ট্রোল করতে পারবেন” কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি তাঁর দেশের এজেন্সিকে লিমিটেশন করেছেন? সেখানেও তো ২৫টি এজেন্সির কথা বলা হয়েছে। এখন সেই এজেন্সি গুলোর প্রতিবাদের মুখে ৫০১টি এজেন্সি সকলেই কাজ করতে পারবে।
তাছাড়া তিনি কিভাবে ভিন্ন দেশের রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিকে কন্ট্রোল করবেন?
দশটি এজেন্সির মাধ্যমে যখন অনিয়ম, দুর্নীতি আর অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় হয়েছিল, তখন কিভাবে কন্ট্রোল করা হয়েছিল?
কর্মী নেয়া বন্ধ করেছিলেন শুধু। তাতে শুধুমাত্র উক্ত এজেন্সি গুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আমাদের বিদেশগামী কর্মী ও আমাদের দেশ।
অবশেষে মালয়েশিয়ায় আমরা কর্মী পাঠাতে চাই, তবে সেটা যে কোনো মূল্যে নয়, আত্মমর্যাদা বিসর্জন ও দেশকে বিকিয়ে দিয়ে নয়। কিছু লোকের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যও নয়। অথবা এই সেক্টরকে বিশাল দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করার জন্যও নয়, বরং বাজার খুলতে হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে।
মালয়েশিয়া যদি সত্যিই লাইসেন্স লিমিটেশন করতে চায়, তাহলে ২৫ টি লাইসেন্স প্রয়োজন নেই, প্রয়োজনে একটি ডেডিকেটেড লাইসেন্স বা বিএমইটি অথবা বোয়েসেলস অথবা একটি অন-স্টপ সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে কম খরচে সকল লাইসেন্সকে সম্পৃক্ত করে কর্মী পাঠানো যেতে পারে।
লেখকঃ
ফখরুল ইসলাম
সাবেক অর্থ সচিব, বায়রা
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post