গল্পটি একজন হতভাগ্য নারীর। চল্লিশ বছর বয়সী ওই নারীর নাম চামেলি বেগম। বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায়। তার স্বামী আরেক হতভাগা ব্যক্তি আবুল হাসান। যিনি একজন প্রবাসী। দু মাস আগে করোনায় মারা যান সুদূর ইরাকের একটি শহরে। এরপর থেকে আবুল হাসানের মরদেহ সেখানকার হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে দাফনের অপেক্ষায়।
আর দেশে তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে দরিদ্র চামেলি বেগমের নির্ঘুম রাত কাটছে। একদিকে মৃত্যুর পর প্রাণ প্রিয় মানুষটিকে একনজর দেখতে না পারার কষ্ট অন্যদিকে দু মাসেও দাফন না হওয়ার কষ্ট এই দুই যন্ত্রণা একজন বাঙ্গালী নারীর জীবনে যে কতটা বেদনার সেই কথা যেন ডুকরে বেরিয়ে এলো চামেলি বেগমের কণ্ঠে।
করোনায় মৃত ব্যক্তির মরদেহ দেশে আনার নিয়ম নেই। ফলে নিষ্ঠুর আইনের মারপ্যাঁচে সুদূর মরুর দেশে আটকে গেছে আবুল হাসানের মরদেহ। প্রিয়জন হারানোর কষ্ট সবারই আছে। কিন্তু চামেলি বেগমের বিষয়টি একদমই আলাদা নয় কি? শেষ বিদায়ে স্ত্রী দেখতে পাচ্ছে না স্বামীর মুখ, সন্তানরা ছুঁয়ে দেখতে পারছে না বটবৃক্ষ পিতার দেহ।
অন্যদিকে জনম দুঃখিনী মা গর্ভের সন্তানকে জীবনের শেষ দেখাটাও পেলেন না। আর তাই তো চামেলি বেগমের চোখে ঘোর অমানিশা। কিভাবে অবুঝ তিন বাচ্চাকে বোঝাবেন তাদের বাবা আর এই দুনিয়ায় নেই! তাদের মানুষই বা কিভাবে করবেন তিনি? কারণ ইরাক যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে আবুল হাসান শেষ সম্বল বাড়িটাই বিক্রি করে দিয়েছেন।
আরো পড়ুনঃ
করোনা রোগীকে স্পর্শ করলেই করোনা হয় না
যেভাবে সরকারি অনুদান পাবেন প্রবাসীরা
বিদেশে মারা গেলে ক্ষতিপূরণ আদায় করবেন যেভাবে
এর সঙ্গে আছে মহাজনের ঋণ। আড়াই বছর আগে যখন তিনি বিদেশ যান তখন ছোট মেয়েটা স্ত্রীর চামেলি বেগমের গর্ভে। আজ পর্যন্ত সে বাপের কোলে উঠতেই পারেনি। এখন এই অবুঝ শিশুটি কাকে বাপ বলে চিনবে? কে বা তার অবুঝ হৃদয়ের ডাক শুনবে?
বিদেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা তার মরদেহ সেদেশেই দাফন করা হচ্ছে। এজন্য দেশে পরিবারকে সরকারের কাছে আবেদন করতে হয়। কিন্তু এই তথ্য না জানা ছিল আবুল হাসানের পরিবারের। এতে হতভাগা এ প্রবাসীর লাশ দুই মাস ধরে পড়ে আছে ইরাকের হাসপাতালে।
বিষয়টি আবুল হাসানের স্বজনদের কাছে কতটা বেদনার প্রবাসীরা নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারছেন। আবুল হাসান ও তার পরিবারের এই গল্প হাজারো প্রবাসীর। যিনি মারা যান তিনি হয়তো বেঁচে যান। কিন্তু দেশে থাকা পরিবারের কি হয়? প্রিয়জনকে শেষ বেলায় দেখতে না পাওয়ার কষ্ট কতটা হৃদয় বিদারক।
এই যেমন পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে ২০১৭ সালে সৌদিআরব যান কুমিল্লার আলমগীর হোসেন। চাকরি করে ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু চলতি বছরের জুনে তার সুন্দর জীবনে হঠাত বিষাদ নেমে আসে। কর্মস্থলে মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হাসপাতালে বর্তি হন।
কিন্তু দূর দেশে তার খোঁজ কে নেবে? ব্যয়বহুল চিকিৎসার টাকাই বা কে দেবে? ফলে কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান আলমগীর। সৌদি যাওয়ার মাত্র ছয় মাস আগে বিয়ে করেছিলেন তিনি। যাওয়ার সময় তার স্ত্রীও ছিলেন গর্ভবতী। এক বছরের মাথায় জন্ম দেন ফুটফুটে একটি সন্তান।
অথচ এই সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগেই পিতাকে হারিয়েছে। আলমগীরের মরদেহ দেশে আনা নিয়েও দেখা দেয় আরেক জটিলতা। যদিও সরকারি খরচে মরদেহ আনার নিয়ম কিন্তু আলমগীরের ভাগ্যে সেটি জোটেনি। কারণ তার হয়ে কেউ সরকারের কাছে যোগাযোগই করেনি। ফলে হতভাগা এই ব্যক্তির দেহ ৬ মাস মর্গে পড়ে থাকার পর প্রবাসীরা উদ্যোগ নিয়ে দাফন করেছে। আর এদিকে আলমগীরকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তার স্ত্রী তীর্থের কাকের মতো স্বামীর অপেক্ষায় দিন রাত পার করছেন।
প্রবাস টাইমে লিখুন আপনিও। প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটির নানা আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা, সমস্যা-সম্ভাবনা, সাফল্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের খবর, ছবি ও ভিডিও আমাদের পাঠাতে পারেন [email protected] মেইলে।
Discussion about this post